পাঠাগার বার্তা ডেস্ক : স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত কিংবদন্তি গীতিকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’- এর মত অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা মাজহারুল আনোয়ারে আজ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে। ষাটের দশকে যখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র, মাজহারুল আনোয়ার লেখেন তার প্রথম গান ‘বুঝেছি মনের বনে রঙ লেগেছে’। নাজমূল হুদা বাচ্চুর সুরে সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানের জন্য গান লেখা শুরু করেন। সে সময় গানপ্রতি মিলতো ৫০ টাকা। সেই দিয়ে তার পেশাদার গীতিকারের জীবন শুরু।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে টেলিভিশনের জন্যও নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বলা হয়, তার লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। রেডিও ও টেলিভিশনে ব্যস্ততার মধ্যেই ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে ডাক পড়ে মাজহারুল আনোয়ারের। সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট সিনেমায় তার ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি শ্রোতার হৃদয়ে আজও অমলিন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রুনা লায়লার গাওয়া প্রথম গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বল কি হবে’ মাজহারুল আনোয়ারেরই লেখা। ১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা’ সিনেমার জন্য (পরে নাম বদলে হয় সংঘাত) মাজহারুল আনোয়ার লেখেন মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রেরণাদায়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। আনোয়ার পারভেজের সুরে সেই গানকেই পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ আর ‘একবার যেতে দে না’- এই তিনটি গান বিবিসির এক জরিপে ২০ শতকের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়।
ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের গানে খ্যাতি পাওয়া প্রায় সব শিল্পীই কখনও না কখনও মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান কণ্ঠে তুলেছেন। সেসব গানে এসেছে প্রেম আর বিরহ, দ্রোহ আর দেশপ্রেম, জীবন আর মৃত্যুচিন্তার কথা।
১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান মাজহারুল আনোয়ার। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত ও প্রযোজিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। এর মধ্যে রয়েছে শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, ক্ষুধা, তপস্যা, উল্কা, পরাধীন, পাষাণের প্রেম,জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া, অগ্নিশিখা, জিঞ্জির, আনারকলি, বিচারপতির মত সিনেমা।
পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে সরকার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়। ১৯৭২ সালে তিনি পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক। চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য, সেন্সরবোর্ড সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
Leave a Reply