জুমচাষী ও তাঁর ছেলে মংসাচিং
চাইহ্লাউ মারমা
পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটি মাচাং ঘরে জন্ম নেওয়া নাম তাঁর চিংসানু মারমা। বয়স বড়জোর হবে পঁচিশ। জুম চাষ করে চলে তার জীবন সংগ্রাম। কখনো পাহাড় ডিঙ্গিয়ে লাকড়ি বিক্রি করতে যেতে হয় শহুরে। জুম পাহাড়ে ফলায় জুম ধান, মারফা, জুম মরিচ, কলা আরো কতকিছু। এই আয়ের উৎস নিয়ে চলে তাঁর জীবনসংগ্রাম। এক সময় চিংসানু এক রোগে মারা যায়। পাঁচ বছর আগে তাঁর বাবাকে হারায় আর বিশ বছর বয়সে তাঁর মাকে। এই পাঁচ বছরে একাই তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। একসময় একটি মেয়েকে তাঁর ভালো লাগে। নাম ছিলো হ্লামেসু।
সময়ে চিংসানু আর হ্লামেসু তাঁদের বিবাহ বন্ধন হয়ে যায়। বছরখানেক পর এক ছেলে নতুন অতিথি আসে। ছেলের নাম রাখা হয় মংসাচিং। মা বাবা আর মংসাচিং মিলে সুখী সংসার চলে তাঁদের। আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগল মংসাচিং। পাঁচেক বছরে পা দিল মংসাচিং এর। পাড়ায় কোন স্কুল ছিল না। কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় তাই অনেক জুমচাষী ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করতে কষ্ট হতো এবং ঝরে যেত। অভিভাবকের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শিখানো মনোযোগ হারায়।
মংসাচিং এর বাবা চিংসানু সকাল সকাল বের হয়ে যায় জুমে। মা ও সাথে যেতো। একসময় মংসাচিং এর মা চিন্তা করলেন আমরা তো সারাদিন জুমচাষ করে ব্যস্ত এবং হয়ত আমাদের জীবন এভাবেই যেতে হবে। কিন্তু! আমাদের ছেলের ভবিষ্যৎ তো আছেই। জুমচাষী হয়ে এভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। সন্ধ্যো হারিকেল জ্বালিয়ে মংসাচিং এর বাবা সাথে আলাপন করলেন এই বিষয়ে। মংসাচিং এর বাবা বলছিল, কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে এতদূর কিভাবে পড়ালেখা করতে পারবে কি আমার ছেলে? বউয়ের কথা না করলেন না। মংসাচিং এর শুরু হল তাঁর শিক্ষা পদযাত্রা। বেশ হাশিখুশিতে মংসাচিং স্কুলে যেতে লাগল। শুরু হল অ, আ, ক,খ। আর পাড়ায় বিহারে খুব ভোরে শিখানো হতো ম্রাইমা ভাষা কাগ্রী, খাখুই।
প্রাথমিক পর্যায়ে শেষ করে হাই স্কুলে পা দিল। ক্লাসে একসময় শিক্ষক সবাইকে জিজ্ঞেস করে তোমরা বড় হয়ে কি কি হতে চাও? একজন একজন করে উত্তর দিলো আমি ডাক্তার হবো, আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো, আমি শিক্ষক হবো ইত্যাদি। এবার মংসাচিং এর পালা, মংসাচিং”কে জিজ্ঞেস করলো মংসাচিং তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? মংসাচিং উত্তর দিলো আমি বড় হয়ে নিজ এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাই। স্যার, কেনো? মংসাচিং উত্তর দিলো যে, আমার মতো আরো নূতন প্রজন্ম পড়াশোনায় যাতে কষ্ট করতে না হয়। শিক্ষক তাঁর কথায় খুব সন্তুষ্ট হলেন।
হাই স্কুল, কলেজের অনার্স মাস্টার্স শেষে নিজের গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন মংসাচিং। এলাকাবাসী সবাই খুশী হলেন। মংসাচিং এর উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন সবাই। সে নিজেই প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব নেন। বাংলা ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি নিজস্ব মাতৃভাষা ম্রাইমা ভাষা পাঠদান শুরু করল প্রাক-প্রাথমিক হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা নিতে লাগল। দুর্গম পাহাড়ে একটি মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলল। এবং দেশ বিদেশে স্কুলটি পরিচিত হতে লাগল।
লেখক : খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি, পাঠাগার বার্তা।
Leave a Reply