হারিয়ে গেছে উৎসব
লিয়াকত হোসেন খোকন
বাংলাদেশের মাটিতে ধানের চাষ চিরদিনের। গ্রাম বাংলার মাটির সঙ্গে ধানের সম্পর্ক নিবিড়। বাংলার মানুষের প্রধান কৃষিজ ফসল হলো ধান। বাংলার মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত আর এই ভাত ধান থেকে উৎপন্ন। তাই কথায় বলে ভেতো বাঙালি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের ধানই হল ধন স্বরূপ। ধান ও ধন ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবে বাঙালি বহুকাল ধরেই লক্ষ্মী দেবীর পুজো করে আসছে। ধান কাটা, ফসল তোলা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেসব পালিত উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – পৌষ তোলা, পৌষ পুজো ও বারোলক্ষ্মীর পুজো। কৃষি ভিত্তিক অঞ্চলগুলিতে এই ধরনের অনুষ্ঠান বেশি হত। ” পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয় আয় আয়, ডালা যে তোর ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায় ” – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার ভাষাতেই আমরা পৌষ মাস ও ফসলের এক তাল, মেল, ছন্দ ও সম্পর্ক খুঁজে পাই। ধন -ঐশ্বর্যের দেবী হিসাবে বহুকাল ধরেই বাঙালি লক্ষ্মী দেবীকে পুজো করে আসছে। তাই পৌষ তোলা বলতে বোঝায় মাঠের লক্ষ্মী ঘরে আনা। কৃষক ভাই কোন একটি জমিতে পাঁচ, সাত, নয় ঝাড় ধান না কেটে সেটিকে পৌষ হিসেবে রেখে আসে। মাঠ থেকে সব ধান আনার পর এই পৌষ ঘরে তোলার পর কাজের সমাপ্তি। সিঁদুর, কাস্তে, জলভর্তি কাসার ঘটি নিয়ে গৃহস্থ লক্ষ্মীকে ঘরে আনতে যান, সঙ্গে যায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেখানে ধানের আটাকে পুজো করে জড় শুদ্ধ ধানের গাছকে নামাবলী পড়িয়ে সিঁদুর দিয়ে মাথায় তুলে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাড়ি আসার পর বধূরা উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি করে পৌষকে চিরতরে ঘরে রাখার উদ্দেশ্যে অর্থাৎ লক্ষ্মীকে চিরতরে ঘরে রাখার কামনায় – ” এসো পৌষ যেওনা জন্ম জন্ম ছেড়োনা /মাঠের পৌষ ঘাটের পৌষ যত পৌষ আমাদের ঘরে এসো ” এই ছড়া পাঠ করে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে বধূরা। মাঘ মাসের প্রথম দিনে সন্ধ্যার সময় বাইরে গোবরের জলের ছড়া দিয়ে পরিস্কার করে নানাবিধ আলপনা এঁকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে পৌষ পুজো করা হয়। একে বারোলক্ষ্মীর পুজো বলে। আলপনার মধ্যে যে বিষয়গুলো আঁকা হয় সেগুলিতে কৃষি প্রধান বাংলাদেশের গ্রামের ছবি ফুটে আসে, যেমন – লাঙ্গল, কোদাল, মই, গরু, মরাই, ধান, পদ্মফুল, প্যাঁচা ইত্যাদি। পৌষ সংক্রান্তিতে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে একসময় উৎসব ও পিঠা বানানোর ধূম পড়ে যেত। দু’দিন ধরে চলত এই উৎসব। তবে গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও আজও পৌষসংক্রান্তিতে পুরুষরা খড়ের ঘর বানিয়ে রাতে বনভোজন করে এবং মহিলারা বিভিন্ন পিঠা পুলি বানায়। কিছু প্রসিদ্ধ পিঠা হল – সিদ্ধ পিঠা, দুধপুলি, মালপোয়া ও চুঙ্গাপিঠা। চুঙ্গাপিঠা এক বিশেষ ধরনের প্রসিদ্ধ পিঠা যা বিরই চাল থেকে বানানো হত। আসলেই একসময় বাঙালিরা অতিথি প্রিয় ছিল, কিন্তু আজকে আর্থিক অভাব অনটনের কারণে বহু উৎসব থেকে তারা সরে এসেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply