দূর্গাদাস : বাংলা সিনেমার প্রথম মহাতারকা
লিয়াকত হোসেন খোকন
দূর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সিনেমা দর্শকের ভাষায় উত্তম কুমারের আগের যুগে- দূর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সিনেমায় ও থিয়েটারে অসম্ভব জনপ্রিয়। ৭০ কি ৭৫ বছর আগের দর্শকরা দূর্গাদাসের ছবি দেখে দেখে ভাবতেন, ইস তিনি তো ‘ডগলাস ফেয়ার ব্যাংকস অব ইস্ট’! কোট, প্যান্ট, টাই এর সংগে মুখে পাইপটা তুললে আর বাঙালি মনে হয় না। তিনিই তো ‘স্টার অ্যাক্টর’। আহা আমি কী পারি না দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হতে!
১৯৩২ সালের ছবি ‘চন্ডীদাস’-এর নায়ক দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আমার মতো চলচ্চিত্র গবেষকদেরকে আজ মনে করিয়ে দেয় অতীত। মাত্র ৫৩ বয়সে ১৯৪৩ সালের ২০ জুন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন। একদা তার অভিনীত- মহুয়া, দেশের মাটি, ভাগ্যচক্র, দিদি, পরশমনি, ঠিকাদার দেখে স্তম্ভিত হয়েছিল বাঙালি। দুর্গাদাসকে নিয়ে আছে কত না মজার ঘটনা, তারই একটি ১৯৩৯ সালের কথা।
বিহারের পাটনা রেল স্টেশন। পাটনা থেকে কলকাতায় আসবেন তখনকার মহাতারকা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। রেল কর্মচারীরা তাকে বললেন, বাংলার মুখ্য মন্ত্রী ফজলুল হক সাহেব কলকাতা যাবেন, আপনার কামরায় তুলে দিই। দুর্গাদাস বললেন, এ কামরা তো আমি রিজার্ভ করেছি। শুনুন, ফজলুল হক যাবেন, আপনি বাধা দেবেন না। আমি ফজলুল হককে চিনিনা। গায়ে কি নাম লেখা আছে?
শুনুন, আপনাকে আবার বলছি।
উনাকে উঠতে দিন।
না, এটা আমার নামে রিজার্ভ করা কামরা।
ফজলুল হক মরলে আরো হবে, কিন্তু দুর্গাদাস মরলে আর দ্বিতীয়টি হবে না। যান আমি এ কামরায় আর কাউকে উঠতে দেবনা।
এই দাম্ভিকতার জন্য দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে জরিমানাও দিতে হয়েছিল। উপমহাদেশ ভাগাভাগির আগে বাঙালির ম্যাটিনি আইডল বলতে তিনি-ই।
দুর্গাদাসের জন্ম চব্বিশ পরগনার কালিকাপুরের জমিদার বংশে ১৮৯১ সালে। নট শেখর নরেশ চন্দ্র মিত্র এই তরুণ সপ্রতিভ সুদর্শন দুর্গাদাসকে ১৯২৫ সালে নিয়ে গেলেন মঞ্চ অভিনয়ে। প্রথম ‘কর্নার্জুন’ নাটকে বিকর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। অল্প দিনের মধ্যেই নায়কোচিত চেহারা, উদাত্ত মধুর কণ্ঠস্বর, অভিজাত চলন-বলন, সুকান্তি-সবটা মিলিয়ে তিনি এক প্রবল ব্যক্তিত্বরূপে পাদ প্রদীপের আলোয় দেখা দিলেন।সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল আত্মপ্রত্যয়ে, যা প্রায়শই দাম্ভিকতা বলে মনে হতো। ১৯২৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত বাংলা মঞ্চ এবং রূপালী পর্দায় দুর্গাদাসের ছিল একচ্ছত্র রাজত্ব। ওই সময়ে তিনি যা পারিশ্রমিক দাবী করতেন, তাই পেতেন।
দুর্গাদাস অভিনীত নির্বাক ছবিগুলোর সংখ্যা ছিলো প্রায় কুড়িটি। নির্বাক চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় ‘মান ভঞ্জন’ ছবিতে। এরপরে -চন্দ্রনাথ, মিশর রাণী, জেলের মেয়ে, ধর্মপত্নী, সরলা, রজনী, বুকের বোঝা, কণ্ঠহার, ইন্দিরা, রাধারানী, ভাগ্যলক্ষীতে অভিনয় করেন। এ সব ছবিতে তিনি ঈর্শ্বনীয় সাফল্য লাভ করেন।
১৯২৫ সালের মিশররাণী ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন নীহারবালা, ১৯২৬ সালের ধর্মপত্নী তাঁর নায়িকা ছিলেন পেসেন্স কুপার, ১৯২৭ সালে কৃষ্ণকান্তের উইল ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন পেসেন্স কুপার, দুর্গেশনন্দিনী এবং চন্ডীদাস ছবিতেও তাঁর নায়িকা ছিলেন ওই পেসেন্স কুপার, ১৯২৮ সালের সরলা ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সীতা ও রাণীসুন্দরী, শাস্তি কি শান্তি ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন প্রভাবতী ও মিস লাইট,১৯২৯ সালের কপাল কুন্ডলা ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন পেসেন্স কুপার, ইন্দিরা ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন মিস লাইট, ১৯৩০ সালের রাধারাণী ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন ললিতা ও লীলাবতী, কণ্ঠহার ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন রেণু বালা ও সবিতা দেবী, ১৯৩২ সালের ভাগ্যলক্ষ্মী ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন উমাশশী ও সবিতা দেবী।
সবাক যুগে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৫ টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন –
দেনা পাওনা (নায়িকা – নিভাননী, ১৯৩২)
কৃষ্ণ কান্তের উইল (নায়িকা – শান্তিগুপ্তা, ১৯৩২)
চিরকুমার সভা (নায়িকা -মলিনা দেবী, ১৯৩২)
চন্ডীদাস (নায়িকা – উমাশশী,১৯৩২)
কপাল কুন্ডলা (নায়িকা – উমাশশী, ১৯৩৩)
মীরাবাঈ (নায়িকা -চন্দ্রাবতী, ১৯৩৩)
মহুয়া (নায়িকা – মলিনা দেবী, ১৯৩৪)
ভাগ্যচক্র (নায়িকা – উমাশশী, ১৯৩৫)
দিদি (নায়িকা – চন্দ্রাবতী, ১৯৩৭)
বিদ্যাপতি (নায়িকা – ছায়াদেবী, ১৯৩৮)
দেশের মাটি (নায়িকা -চন্দ্রাবতী, ১৯৩৮)
পরশমনি (নায়িকা – রানীবালা, ১৯৩৯)
ঠিকাদার (নায়িকা, রেনুকা রায়ের বাবার ভূমিকায়, ১৯৪০)
অবতার (নায়িকা – জ্যোস্না গুপ্তা, ১৯৪১)
প্রিয় বান্ধবী (নায়িকা – চন্দ্রাবতী, ১৯৪৩)
দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘প্রিয়বান্ধবী’ মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালের ২৩ জানুয়ারি, চিত্রায় । নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে নির্মিত এ ছবিতে তাঁর সহশিল্পীরা হলেন – চন্দ্রাবতী দেবী, জহর গাঙ্গুলী, চিত্রা, শৈলেন চৌধুরী, রাধারাণী, শ্যাম লাহা, কৃষ্ণা, সত্য মুখোপাধ্যায়, নমিতা, খগেন পাঠক, নরেশ বসু, সুশীল রায়, হরিমোহন বসু, প্রভাত চট্টোপাধ্যায়, কালী গুহ, সুবির মিত্র, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, অজিত মিত্র, কৃষ্ণ দাস, কেনারাম বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ দাস প্রমুখ। পরিচালক ছিলেন সৌমেন মুখোপাধ্যায় ।
ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের মালিক বাবুলাল চোখানির সঙ্গে নানা কারণে মতবিরোধ হওয়ায় দুর্গাদাস ‘জীবনসংগিনী’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় কাজ শুরু করেও ছেড়ে দিলেন (১৯৩৬)।
সেই শূণ্যস্থান পূরণ করেই ছবি বিশ্বাস সিনেমা দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী দাম্ভিক দুর্গাদাস বলেছিলেন, ‘আমি ছেড়ে দিলে বাবুলাল চোখানির ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের কিছুই থাকবে না -থাকবে শুধু বাবুলালজী আর হনুমানজী।’ ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের আয়ু শেষ হয়ে গেল।
এদিকে দুর্গাদাসের প্রতিভাময় শিল্পী-জীবনের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। তার শেষ ছবি-‘প্রিয় বান্ধবী’। এই ছবিতে নায়িকা চন্দ্রাবতীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি যখন নায়কের ভূমিকা করছেন তখন রোগে অমিতাচারে তার শরীর জীর্ণ হয়ে এসেছে। প্রচুর মদ্য পানে ও প্রচুরতর অমিতাচারে প্রতিভাবান নট দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যয়ের জীবনদীপ নির্বাপিত হল (১৯৪৩)। কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি প্রতিভার আত্মপ্রত্যয় ও আভিজাত্য পরিত্যাগ করেন নি। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা মঞ্চ ও চিত্রজগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার তুলনা সহজে মেলে না।
লেখক : চলচ্চিত্র গবেষক।
Leave a Reply