1. admin@pathagarbarta.com : admin :
বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাবের দুইদিনব্যাপী সাহিত্য পর্যটন মিশন মহেশখালী কক্সবাজার ৮ ও ৯ নভেম্বর নবীগঞ্জে শারদ সংকলন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত স্বপ্নবিলাস উন্মুক্ত পাঠাগারের উদ্যোগে পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত সৌম্যেন অধিকারীর কণ্ঠে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ স্মরণে প্রথম বাংলা গান মিডল্যান্ডস সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ ইউকে সভায় বার্মিংহামে বিজয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত লেখা আহবান ইউকের বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভা অনুষ্ঠিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার লন্ডনে আনন্দ ও উৎসবে দ্বাদশ বাংলাদেশ বইমেলা এবং সাহিত্য সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত

নদীর নামের বৈচিত্র্য ও সংখ্যাগত বিভ্রান্তি -আব্দুল করিম কিম

পাঠাগার বার্তা
  • আপডেট সময় : রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৬০ বার পঠিত

নদীর নামের বৈচিত্র্য ও সংখ্যাগত বিভ্রান্তি
আব্দুল করিম কিম

বাংলার জনপদে জালের মতো বিছানো রয়েছে সহস্রাধিক নদনদী। নদীর সংখ্যা নিয়ে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীর সংখ্যা এখনও নিরূপণ করতে পারেনি। যেমন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণামতে, দেশে নদীর সংখ্যা ৪০৫। অপরদিকে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস-সিইজিআইএস বলছে, নদনদীর সংখ্যা ৪৪৫। সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের জরিপে ৮৫৭টি নদী পাওয়া গেছে। বস্তুত সরকারি তথ্য বাতায়নে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগে দেওয়া নদীর তালিকার তারতম্য দেখলেই বোঝা যায়, নদীর সংখ্যা তালাশ করার চেষ্টা অপ্রতুল।

বেসরকারি হিসাবে দেশে নদনদীর সংখ্যা অবশ্য সরকারি সংস্থার হিসাব থেকে বেশি। যেমন পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের নদনদী’ গ্রন্থের (জনান্তিক/২০২০) তথ্যমতে, দেশে নদীর সংখ্যা ১১৮২। রিভারাইন পিপল নামে একটি নাগরিক সংগঠনের তথ্যমতে, দেশে নদনদী তথা প্রাকৃতিক প্রবাহের সংখ্যা যে কোনো বিবেচনাতেই এক হাজারের ওপরে। সংগঠনটির মতে, আইনি সংজ্ঞা না থাকায় নদনদীর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের নদীর নাম জানতে চেয়ে নদী গবেষকদের একাধিক গবেষণাগ্রন্থ তল্লাশি করেছি। বিভিন্ন গবেষকের দেওয়া তথ্যে প্রায় ১৩শ নদীর নাম পাওয়া গেছে। শুধু সিলেট বিভাগেই নিজস্ব অনুসন্ধানে পেয়েছি দুই শতাধিক নদীর সন্ধান।

নদীর নাম নদী রাখে না। নদীর নাম রাখে নদীতীরের মানুষ। তাই নদীর নাম অঞ্চলভেদে বদল হয়। একই নদীর নাম ভিন্ন জনপদে ভিন্ন হয়েছে। পশ্চিমবাংলার গঙ্গা পূর্ববাংলায় পদ্মা হয়। মেঘালয়ের উমঙ্গট নদী বাংলাদেশে হয় ‘ডাউকি’। আবার ‘ডাউকি’ কিছু পথ পাড়ি দিয়ে ‘গোয়াইন’ নাম ধারণ করে। উপমহাদেশের নদীকে পুরুষ ও স্ত্রীবাচক নামে নামকরণ করা হয়েছে। ফলে নদীর নাম বলতে যেয়ে লিঙ্গ ঠিক রাখতে হয়। নদীর এ রকম লিঙ্গ-বিভাজন উপমহাদেশ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। তাই উজানের ব্রহ্মপুত্র ‘নদ’ হলেও একই নদী ভাটিতে এসে যমুনা ‘নদী’ হয়ে যায়।

নদীর এই লিঙ্গ নির্ধারণ মূলত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণে। ভারতীয় উপমহাদেশে নদী মাতৃজ্ঞানে পূজিত হয়। গায়ত্রী মন্ত্রে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী প্রভৃতি নদী বা নদীশক্তি এই জলে দেব-দেবীজ্ঞানে উপস্থিত। পৌরাণিক বিশ্বাসেই এই অঞ্চলের বিভিন্ন নদনদীর নামকরণ হয়েছে। তাই বাংলার অসংখ্য নদনদীর নামকরণ হয়েছে দেব-দেবীর নামে।এখানে ঈশ্বরের নাম যুক্ত নদ আছে কানেশ্বর, তালেশ্বর, বলেশ্বর, বুড়িশ্বর, ভুবনেশ্বর, ঘণ্টেশ্বর। আবার ঈশ্বরী নামযুক্ত নদী আছে কাগেশ্বরী, কাকেশ্বরী, গর্ভেশ্বরী, ধলেশ্বরী, নাগেশ্বরী, ফুলেশ্বরী, বলেশ্বরী, ভাটেশ্বরী, মঙ্গলেশ্বরী, মুক্তেশ্বরী, মুকুলেশ্বরী, যমুনেশ্বরী, সিদ্ধেশ্বরী, সোমেশ্বরী।

সনাতন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত দেবতা, অবতার, ঋষি ও পৌরাণিক চরিত্রের নামে নদ আছে ব্রহ্মপুত্র, শিব, বিষ্ণু, হরি, হরিহর, ভৈরব, শশীভূষণ, গঙ্গাধর, কালিদাস, গদাই, নিতাই, গোপ, গৌর, মনু, গুণধর, পাণ্ডব, নারদ, বলভদ্র, হংসরাজ, কংস, কালাইয়া, বুড়াগৌরাঙ্গ। আবার দেবীর নামে নদী আছে পদ্মা, যমুনা, কালিন্দী, ভদ্রা, কালি, মন্দাকিনী, সরস্বতী, সুবচনী।

আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার মূল প্রবাহ বাংলাদেশে এসে সাধারণভাবে ‘পদ্মা’ নামে পরিচিত হলেও গোয়ালন্দে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দাপ্তরিকভাবে ‘গঙ্গা’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া গঙ্গা নামযুক্ত নদী আছে একাধিক। ঢাকায় আছে ‘বুড়িগঙ্গা’; মানিকগঞ্জ ও নড়াইলে আছে ‘কালিগঙ্গা’, দিনাজপুরে ‘তুলসীগঙ্গা’, চুয়াডাঙ্গায় ‘নবগঙ্গা’, গাজীপুরে ‘গুপ্তগঙ্গা’।

চণ্ডী বা চণ্ডিকা হলেন ভয়ংকরী ও ক্রোধোন্মত্তা দেবী। চণ্ডী নামযুক্ত নদী আছে সিলেটে ‘চরচণ্ডী’, ময়মনসিংহে ‘চণ্ডীপাশা’, কুড়িগ্রামে ‘চণ্ডীজান’, রংপুরে ‘ভিনাইচণ্ডী’, পঞ্চগড়ে ‘রণচণ্ডী’।

নদীর প্রতিটি বাঁক একেকটি বিচিত্র ইতিহাস। তাই এখানে নদীর নাম হয় আঠারোবাঁকী, ফেনারবাঁক, বাঁকহারা, দাঁড়ছিঁড়া, দড়াটানা, নাওডোবা, গাঙ্গডুবি, গলচিপা। নদী এখানে ‘আগুনমুখা’ হয়, ‘সোনামুখী’ হয়; ‘দুধমুখী’ হয়। আবার বড় জলাশয়ের অতলস্পর্শ স্থান বা ঘূর্ণিময় অংশ, যা দহ নামে পরিচিত। সেই দহকে কেন্দ্র করে নদীর নামকরণ হয় সিরাজগঞ্জে ‘গাঢ়দহ’ ও ‘দুর্গাদহ’, সাতক্ষীরায় ‘বাঁশদহ’, গাজীপুরে ‘লবণদহ’, নওগাঁয় ‘রক্তদহ’, বগুড়ায় ‘সুখদহ’, জামালপুরে ‘মাদারদহ’ গোপালগঞ্জে ‘শৈলদহ’, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘জামদহ’।

নদীর প্রবাহ দেখে নাম হয় কলকলিয়া (হবিগঞ্জ), হলহলিয়া (কুড়িগ্রাম), ঝনঝনিয়া (গোপালগঞ্জ), ঝপঝপিয়া (খুলনা), জিরজিরা (জামালপুর), গড়গড়া (গাজীপুর), গড়াই (নওগাঁ), ফানাই ও কণ্ঠীনালা (মৌলভীবাজার), টাঙ্গাইলে ‘নালী’, সুনামগঞ্জে ‘চলতি’।নদীর সঙ্গে বালুর সম্পর্ক আছে বলে বালু (গাজীপুর), বালিখাল (হবিগঞ্জ), বালুখালী (চট্টগ্রাম), বালুভরা (নওগাঁ) নদী যেমন আছে; তেমনি মাটির সম্পর্ক রেখে কাঁচামাটিয়া (ময়মনসিংহ), রাঙ্গামাটিয়া (বরিশাল) নামের নদী আছে। আবার ভারতের অযোধ্যার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিরাঙ্গায় আছে ‘অযোধ্যা’ নদী।ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন কেন্দ্র বালির সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াই বান্দরবানে আছে ‘বালি’ নদী। বগুড়া ও ভোলা থেকে বহু দূরে বাগেরহাটে আছে ‘বগুড়া’ ও ‘ভোলা’ নদী। দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া থেকে বহু দূরে ভোলা ও হবিগঞ্জের লাখাইয়ে আছে ‘তেঁতুলিয়া’ নামে দুই পৃথক নদী। দইতলা (যশোর), পাইকেরতলা (সুনামগঞ্জ) ও বাঁশতলা (সাতক্ষীরা) নামেও নদী আছে।

বাংলার প্রতিটি নদীর বাঁকে রয়েছে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনার ইতিহাস। নদীতীরের মানুষের মুখে মুখে ফেরা লোকগাথার গল্প ও রূপকথার উপাদান নদীর নামকরণে প্রভাব রাখে। তাই ‘আলাইকুমারী’ (রংপুর) নামে যেমন নদীর দেখা পাওয়া যায়, তেমনি ‘পাথরাজ’ (পঞ্চগড়), ‘ঘনরাজ’ (খুলনা), ‘পঙ্খিরাজ’ (সোনারগাঁ), ‘দুধকুমার’ (কুড়িগ্রাম), ‘ফুলকুমার’ (কুড়িগ্রাম), ‘নীলকমল’ (কুড়িগ্রাম) নামে নদের নামও পাওয়া যায়। আবার ইরাবতী, কান্তাবতী, চন্দ্রাবতী, টঙ্কাবতী, লবঙ্গবতী, বেগবতী, বেত্রাবতী, ভদ্রাবতী, হারাবতী নামে ‘বতী’-যুক্ত নদী যেমন আছে, তেমনি আছে ‘মতী’-যুক্ত নদী। ইছামতী, কাঁচামতী, গোমতী, ভেলামতী, মধুমতী, স্বর্ণমতী। মতীতেই শেষ নয়; নওগাঁ জেলায় ‘হীরা’ নামের নদী আছে।পটুয়াখালীতে আছে ‘আন্ধারমানিক’।হীরা-মতি-মানিক থাকবে অথচ সোনা বা রুপা থাকবে না? সুন্দরবনের কয়রাতে ‘সোনা’ নামের নদী আছে। হবিগঞ্জে আছে ‘সোনাই’, কুড়িগ্রামে আছে ‘সোনাভরী’, কুমিল্লাতে আছে ‘সোনাইমুড়ী’, মুন্সীগঞ্জে আছে ‘সোনারং’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আছে ‘সোনাহর’। সুনামগঞ্জে আছে ‘রূপাছড়া’।নদীর নামে এত ধনরত্ন! তাই ‘রত্না’ নামে আছে সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে তিনটি পৃথক নদী। আবার ‘খাজাঞ্চি’ নামেও নদী আছে। ধনরত্ন আছে বলে ‘বিলাস’ (শ্রীমঙ্গল) আছে; ‘বিলাসী’ (রাজশাহী) আছে।

পৌরাণিক গল্পে দেব-দেবী, রূপকথার রাজকুমার- রাজকুমারী আর ধনরত্নেই শেষ নয়; নদীতে পাওয়া জলজ প্রাণ ও নদীতীরের প্রাণপ্রকৃতির প্রভাব নদীর নামকরণে ভূমিকা রাখে। তাই পাখির নাম, ফলের নাম, ফুলের নামেও নদী পাওয়া যায়। মাছের নামে, গাছের নামে, তৃণের নামেও নদী হয়।

পাখির নামে পটুয়াখালীতে আছে ‘পায়রা’, খুলনায় আছে ‘ময়ূর’, দিনাজপুরে আছে ‘শুক’ (টিয়া), সিলেটে আছে ‘সারি’ (শালিক), বাগেরহাটে আছে ‘বগী’, সিলেটে আছে ‘কুড়া’, রাজশাহীতে আছে ‘কোয়েল’, রাজবাড়ীতে আছে ‘চন্দনা’, পঞ্চগড়ে আছে ‘ডাহুক’, সুনামগঞ্জে আছে ‘ডাহুকা’, মৌলভীবাজারে আছে ‘মুনিয়া’। আবার সাতক্ষীরায় কাকের সঙ্গে শিয়াল মিলে আছে ‘কাকশিয়ালী’ নদী। ‘মৃগা’ নামে নদী আছে কিশোরগঞ্জে। ‘গিরগিট’ নামে নদী আছে সিলেটে।

ফলের নামে পাবনায় আছে ‘কমলা’, সুনামগঞ্জে আছে ‘খুরমা’ ও কুমিল্লায় ‘কালাডুমুর’ নদী। সিলেটের জকিগঞ্জে আছে ‘তাল’ ও ‘কুল’ নামে দুই গাং।

ফুলের নামে নদী আছে। নীলফামারী জেলায় ‘কেতকী’ ও গাজীপুর জেলায় ‘পারুল’। তবে ফুলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নদীর নাম রাখা হয়েছে সাতক্ষীরায় ‘মালঞ্চ’, মুন্সীগঞ্জে ‘ফুলদি’, সিরাজগঞ্জে ‘ফুলজোড়’, কিশোরগঞ্জে ‘ফুলহার’।

মাছের নামে নদী আছে। ভোলায় ‘ইলিশ’, নীলফামারীতে ‘ঘাঘট’। ঝালকাঠিতে ‘পোনা’ নামে নদী আছে। দিনাজপুরে আছে ‘কাঁকড়া’, কিশোরগঞ্জে ‘ঝিনুক’, চট্টগ্রামে ‘শঙ্খ’, সিলেটের জৈন্তাপুর ও বিশ্বনাথে ‘কাফনা’ (ঝিনুক) নামে আলাদা দুই নদী আছে।

গাছের নামে নদী আছে। বাগেরহাটে ‘পশুর’ ও সুনামগঞ্জে ‘বটেরগাং’। তৃণ ও গুল্মের নামে নদী আছে ভোলায় ‘কলমি’, শরীয়তপুরে ‘পালং’, মাদারীপুরে ‘ময়নাকাঁটা’, বরিশালে ‘লতা’। সিলেটে আছে ‘শ্যাওলা’।

ঝাল-মিষ্টি-নোনতা নিয়েও নদী আছে। ‘লঙ্কা’ আছে বরিশালে, ‘গুড়’ আছে নাটোরে। ‘ক্ষীর’ নদী আছে ময়মনসিংহে। ‘লোনা’ নদী আছে ঠাকুরগাঁওয়ে, ‘নুনছড়া’ আছে সিলেটে। খাবারদাবার নিয়েও নদী আছে। ‘কালিজিরা’ আছে বরিশালে, সুনামগঞ্জে আছে ‘লাউগাঙ’। ‘লাচ্ছি’ নদী আছে ঠাকুরগাঁওয়ে। খাবার পর পান-সুপারির প্রয়োজন। বাগেরহাটে আছে ‘পানগুছি’। চা-সিগারেট না থাকলেও ‘হাঁড়িয়া’ আছে খুলনায়।

বাগেরহাটের ‘পুঁটিমারা’ থেকে শুরু করে লালমনিরহাটে ‘সিঙ্গীমারা’, খুলনায় ‘শোলমারা’র মধ্যেই নদীর মারামারি থেমে নেই। খাগড়াছড়ির ‘গুইমারা’, সাতক্ষীরায় ‘সাপমারা’, পঞ্চগড়ে ‘ঘোড়ামারা’, হবিগঞ্জে ‘হাতিমারা’ আছে। এমনকি চুয়াডাঙ্গায় ‘ভাইমারা’ ও সুনামগঞ্জে ‘খাসিয়ামারা’ নামেও নদী আছে। নওগাঁ জেলায় আছে ‘জবাই’ নদী।এখানেই শেষ নয়। ভাঙাভাঙির মধ্যেও নদী আছে। মেহেরপুরের ‘মাথাভাঙ্গা’, নীলফামারীর ‘চুঙ্গাভাঙ্গা’, সাতক্ষীরার ‘হাঁড়িয়াভাঙ্গা’, হবিগঞ্জে ‘হাওরভাঙ্গা’, পটুয়াখালীর ‘খাপড়াভাঙ্গা’, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘নাওভাঙ্গা’ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ছিটিভাঙ্গা’। মারামারি ও ভাঙাভাঙির পর মামলা-মোকদ্দমার বিষয়ও আছে। তাই ফেনীতে ‘মুহুরী’, মৌলভীবাজারে ‘জুড়ী’ আর রংপুরে আছে ‘কাঠগড়া’ নদী! মামলা-মোকদ্দমায় টাকাপয়সা দরকার। তাই যশোরে আছে ‘টেকা’, বরিশালে ‘পয়সা’, সিরাজগঞ্জে ‘দশসিকা’, জামালগঞ্জে আছে ‘দশানী’ নদী।

আবহমান বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ নদী। নদীকেন্দ্রিক ছিল আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিটি নদী ও নৌপথ চিহ্নিত করতে ছোট-বড় সব নদীর নামকরণ হয়েছে। নদীতীরবর্তী মানুষ ও নদীপথ ব্যবহারকারীরা দিয়েছে এসব নদীর নাম। নদীর আধিক্যের কারণে নামেও সংকট হয়েছে। তাই যাপিত জীবনের বিভিন্ন উপকরণে নদীর নাম হয়েছে। যেমন– ‘ঢাকী’ (খুলনা), ‘বংশী’ (টাঙ্গাইল), ‘সুঁই’(পঞ্চগড়), ‘সুতি’(গাজীপুর), ‘কুলা’(কিশোরগঞ্জ), ‘থাল’(মৌলভীবাজার), ‘ঘুড্ডি’(নাটোর), ‘বল’(নেত্রকোনা), ‘সরাই’(গাইবান্ধা), ‘সবগাড়ি’(বগুড়া), ‘কারখানা’(বরিশাল), ‘টিকেট’(সাতক্ষীরা), ‘বিজলী’(ব্রাহ্মণবাড়িয়া), ‘লাইন’(সিলেট)।

বাংলায় নদীকে মাতৃজ্ঞান করলেও ময়মনসিংহে ‘বাজান’ নামে নদ আছে। আবার নদের শালাশালি না থাকলেও নদীর ‘দেওর’ (ময়মনসিংহ) আছে। ‘দেওরভাগা’ও (সিলেট) আছে। ‘বুড়ি’ নদী আছে কুমিল্লায়। ‘রূপসী’ আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। রূপসী আছে বলে পঞ্চগড়ে আছে ‘ঘাগড়া’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ঘুঙ্গুর’, নরসিংদীতে ‘কাঁকন’। আবার পঞ্চগড়ে ‘বোরকা’ নামে নদী আছে। দিনাজপুরে ‘রসিয়া’ আছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আছে ‘পাগলা’, কুমিল্লায় আছে ‘পাগলি’। সিলেটে আছে ‘ধলা’, দিনাজপুরে আছে ‘কালা’। হবিগঞ্জে যেমন ‘শুঁটকি’ নদী আছে, পঞ্চগড়ে তেমনি ‘পেটকি’। আবার পাবনায় আছে ‘চিকনাই’ নদী। ‘সতা’ নদ আছে নেত্রকোনায়, ‘সতি’ আছে লালমনিরহাটে। ‘বামনী’ আছে নোয়াখালীতে। ‘ফকিরনি’ আছে নওগাঁ জেলায়। আবার ‘শ্রী’ নদী আছে খুলনায়। ‘শ্রীমন্ত’ আছে পটুয়াখালীতে। ফরিদপুরে আছে ‘কুমার’, চট্টগ্রামে আছে ‘ধোপা’, নওগাঁয় আছে ‘গোয়ালা’, আবার সিরাজগঞ্জে আছে ‘গোহালা’। নদী এখানে ‘লুলা’ (সিলেট) হয়, ‘খোড়া’ (নীলফামারী) হয়। আবার ‘বোকা’ (ছাতক) হয় ‘খ্যাপা’ও (সিলেট) হয়। ‘মাকুন্দা’ (সিলেট) হয়, ‘পুরুষালি’ (ফরিদপুর) হয়। নদী ‘ছেঁড়া’ (খুলনা) হয়। নদী ‘ফুটা’ (টাঙ্গাইল) হয়। নদী ‘পান্ডা’ হয়, ‘চেলা’ হয়।

কিছু নদীর নাম লোকায়ত এমন সব শব্দে, যেগুলোর অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। যেমন ‘মগরা’ (নেত্রকোনা), ‘ফটকি’ (মাগুরা), ‘পাঙ্গা’ (পঞ্চগড়), ‘মাঙ্গা’ (খুলনা), ‘মৃগী’ (শেরপুর), ‘আঁটি’ (গাজীপুর), ‘পুঙ্গলী’ (টাঙ্গাইল), ‘মঘা’ (ময়মনসিংহ), ‘ল্যাঙ্গা’ (গাইবান্ধা), ‘হাবড়া’ (সাতক্ষীরা), ‘হোজা’ (রাজশাহী), ‘আফ্রা’ (নড়াইল), ‘নির্বিষখালী’ (মাগুরা)।

আমাদের প্রধান ও পরিচিত নদীগুলোর নাম কী মিষ্টি! ‘আত্রাই’, ‘আলোকছত্রা’, ‘কপোতাক্ষ’, ‘করতোয়া’, ‘কর্ণফুলী’, ‘কর্ণজোরা’, ‘কর্ণতলী’, ‘কহুয়া’, ‘কাকতারা’, ‘কাজলা’, ‘কাঞ্চন’, ‘কালনী’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কীর্তিনাশা’, ‘কুশিয়ারা’, ‘কোহেলিয়া’, ‘খোয়াই’, ‘ঘোরাউত্রা’, ‘চিত্রা’, ‘জয়ন্তী’, ‘জয়া’, ‘জলঢাকা’, ‘জলশুকা’, ‘জলসিড়ি’, ‘ঝিনাই’, ‘টাঙ্গন’, ‘ডাকাতিয়া’, ‘তালমা’, ‘তিতাস’, ‘তিথি’, ‘তিস্তা’, ‘তুষাই’, ‘ধনু’, ‘ধরলা’, ‘ধানতারা’, ‘ধানসিড়ি’, ‘নওতারা’, ‘নরসুন্দা’, ‘নলশীশা’, ‘নীলাক্ষী’, ‘পাহাড়িকা’, ‘পিয়াইন’, ‘পুনর্ভবা’, ‘প্রাণসায়র’, ‘বড়াল’, ‘বাদলা’, ‘বাসিয়া’, ‘বিবিয়ানা’, ‘বিলসূর্য’, ‘বিষখালী’, ‘মহানন্দা’, ‘মালিঝি’, ‘মেঘনা’, ‘যাদুকাটা’, ‘রক্তি’, ‘রজতরেখা’, ‘রাংপানি’, ‘রূপসা’, ‘রেমাক্রি’, ‘লৌহজং’, ‘শীতলক্ষ্যা’, ‘ষাটমা’, ‘সন্ধ্যা’, ‘সুগন্ধা’, ‘সুনন্দা’, ‘সুবতি’, ‘সুরমা’, ‘শিবসা’, ‘হাঁড়িদোয়া’, ‘হুরসাগর’ ইত্যাদি।

নদীর এই নামকরণ দেখে আমাদের পূর্বসূরিদের সংস্কৃতিবোধ নিয়ে গর্ব করতে হয়। অর্থবহ, সুমিষ্ট, শ্রুতিমধুর ও বৈচিত্র্যময় নামের সব নদী বাঙালির সমৃদ্ধ মনস্তত্ত্বের সন্ধান দেয়। বাঙালি নিজের জাতিসত্তার নামে তাই নদীর নাম রাখে ‘বাঙালী’(সিরাজগঞ্জ) ।সংখ্যা নিয়ে যখন বিভ্রান্তি, নাম নিয়ে যখন বৈচিত্র্য; তখন খোদ নদীই কিন্তু ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত ছোট ছোট প্রবাহ দখল ও অপরিকল্পিত স্থাপনার চাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে শুধু নামেমাত্র টিকে রয়েছে। পূর্বে ‘পুকুর চুরি’ হতে দেখা গেলেও দেশে এখন নদীও চুরি হয়। সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর দায় কম নয়। যেমন প্রবহমান নদীকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে লিজ দেওয়ার অসংখ্য সংবাদ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। নদীকে খাল বলার প্রবণতা বাড়ছে। নদী খাল হলে, খাল ড্রেন হয়ে যায়। নদীকে ড্রেন হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে নদীর নাম জানা ও জানানো জরুরি। নদী নিজ নামে পরিচিত হলে নদীকে বাঁচানোর চেষ্টা হবে। নদীর অধিকার ক্ষুণ্ন করা হলে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হবে। তখন হয়তো নদী বাঁচানোর চেষ্টা হবে। তাই নদীর নাম জানা প্রয়োজন।

শেষ কথা, নদীকে যে নামেই ডাকা হোক, যেখানেই নদী থাকুক, নদীকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাতে হবে। নদীতীরের মানুষ নিজের নদীকে ভুলে গেলে নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে নদীবহুল দেশ আমাদের বাংলাদেশ। নদীই আমাদের মূল সম্পদ। নদীকে কেন্দ্র করেই আমাদের সব কার্যক্রম হওয়া উচিত। নদী নিয়ে এ দেশে উৎসব হতে পারত; হতে পারত পর্যটন। নদীকেন্দ্রিক হতে পারত যোগাযোগ ব্যবস্থা। হয়নি কিছুই। বরং নদী ধ্বংসের উৎসবে মেতে আছি সবাই! কবে হবে আমাদের বোধোদয়?

লেখক : নদী গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

এক ক্লিকে বিভাগের খবর

error: Content is protected !!