নারী প্রগতিতে সুলতানা রাজিয়া আজও শীর্ষে
লিয়াকত হোসেন খোকন
যুগে-যুগে নারীরা প্রগতির পতাকা উড়িয়ে গেছেন। বেশভূষায়, কর্মকাণ্ডে, যুদ্ধবিগ্রহে নারীরা অনেক এগিয়েছিলেন। মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ছিলেন আঠারো শতকের ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীদের একজন। একালের নারীবাদীরা তাঁকে আইকন মনে করেন। সুলতানা রাজিয়া, মমতাজ মহল, জাহানারা, রওশান আরা প্রমুখও পোশাকে আশাকে বেশভূষায় ছিলেন প্রগতিশীল। সুলতানা রাজিয়ার পুরো নাম সুলতান রাজিয়া-উদ দুনিয়া ওয়া উদ্দিন। তিনি ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা ও ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। তিনি পুরুষের মতো পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন ১২৩৮-৩৯ সালে। হিজাব নয়, পুরুষের মতো ঘোড়া চালিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করেছেন শত্রু’র সঙ্গে। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতী ও যুদ্ধবিদ্যায় পটু। ১২৩৬ সালে দিল্লির জনগণের সাহায্য নিয়ে রাজিয়া সুলতানা তার ভাইকে অপসারণ করে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। সুলতানা রাজিয়া নারীত্বের আবরণ পরিত্যাগ করে, পুরুষের পোশাক গ্রহণ করেন। এই পোশাকে তিনি জনসম্মুখে, প্রশাসনে ও যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন। আজ এমনটি কী ভাবা যায়? পুরুষের মতো পোশাক পরতেন বলে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। এজন্য দিল্লিতে যতবার গিয়েছি ততবারই পুরনো দিল্লির বুলবুল-ই-খানা মহল্লায় গিয়ে তাঁর সমাধিতে ফুল দিয়ে একটা কথাই বলতাম, হে খোদা, তুমি সকল নারীদেরকে সুলতানা রাজিয়ার মতো সাহসী করে তোলো।
আধুনিক যুগের বিতর্ক হিজাব নিয়ে, বোরখা-হিজাব বস্ত্রখণ্ডটি সামান্য হলেও অসামান্য। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে পুরুষসমাজের প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহের ইঙ্গিত। তা না হলে এমনিতেই মুখ ঢেকে রাখার সার্বিক গ্রহণযোগ্য যুক্তি কী আর থাকতে পারে? যদি শুধু চোখ দু’টিকে বাদ দিয়ে বাকি মুখমন্ডলকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখে, তা অনেক ক্ষেত্রেই আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, মহিলা হলেই যে নির্দোষ গুণসম্পন্ন হবেন, এমন তো হতে পারে না। তাই চট করে সময়বিশেষে তার সনাক্তকরণ খুবই মুশকিল। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় কিম্বা ব্যাঙ্কে কার হয়ে কে কী করছে, ধরে নেওয়া দুঃসাধ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে হিজাব প্রতিনিয়ত সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাছাড়া শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন এসেছে। মহিলাদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ সমাজের সঙ্গেই চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট-বাজার ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহিলাদের তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে। এসব পরিস্থিতিতে আমরা পুরুষসমাজকে নারীর ক্ষতিকর বলে ভেবে বসি না। অশালীন পোশাক ও আচরণের বিজ্ঞাপন ঘরে-বাইরে, দোকানে সাঁটিয়ে দিতে রুচিতে বাঁধে না। হিজাব চালুর পক্ষে যারা, তারা মহিলাদের নির্বাচনে অংশ নিতে কিম্বা ব্যবসায় যোগ দিতে তাদের আপত্তির কথা কখনও শুনিনি। অথচ এই কাজগুলোতে পুরুষের সান্নিধ্য বেশি, অশালীনতার চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। প্রকৃত পক্ষে সমাজে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে শিক্ষাই দেওয়া হয়, যা শালীনতার শিক্ষা। এক টুকরো বস্ত্রখণ্ড আর কতকাল মেয়েদের শালীনতা আগলে রাখবে। তালিবান শাসন যদি যথার্থ ইসলামি শাসন হয়, আর সেটাই যদি হিজাব সমর্থকদের কাঙ্ক্ষিত হয়, তবে মেয়েদের হিজাব থাকলেও নিঃসন্দেহে তাদের পড়াশোনা, চাকরি, নির্বাচনের অধিকার লাটে উঠবে। অতএব, নির্ধারণ করতে হবে যে, আমাদের কোনটা কাম্য। প্রগতিশীল ভাবনাসমৃদ্ধ বিজ্ঞানমনস্কতা, শান্তিপূর্ণ আনন্দময় জীবন, না সেকেলে ভাবনাকে এখনও টিকিয়ে রাখার যুক্তি অন্বেষণ করা।
গ্রীষ্মকালীন দেশের অস্বস্তিকর পরিবেশে হিজাব পরিধান করা কি আজকের শিক্ষায় মান্যতা দেবে? মুসলমান মেয়েরা যদি কষ্ট স্বীকার করেই হিজাব পরিধান করেন, বাকি সবাই এতে সহনশীল মানসিকতা রেখে চলা উচিত। যুগ যুগ ধরে মায়েরা -মেয়েরা হিজাব-বোরখার ভার বইবেন পুরুষদের নজর এড়ানোর জন্য, তাতে পুরুষদের কি কোনও ভূমিকা থাকবে না? তাদেরও সভ্য, সংযত, সজ্জন হওয়া উচিত নয় কী? আমাদের তো মনে হয়, মেয়েদের শালীনতা রক্ষার দায়িত্ব মানুষ মাত্রেই হওয়া উচিত। শুধুমাত্র মেয়েদের একার নয়, নারী-পুরুষ সবার। হিজাবের পক্ষে এবং বিপক্ষে দুই দল রয়েছে। তাই এ বির্তকেও কেউ এতটুকু জমি ছাড়তে নারাজ।
এতদিনের পুরনো মূল্যবোধকে যুগোপযোগী না করে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতেই আমরা যখন অধিক মনোযোগী হই, তখন সমাজের ভাবনা দু’ভাগ হতে বাধ্য। এদের এক পক্ষ সংশোধনবাদী, অপরপক্ষ রক্ষণবাদী। এক পক্ষকে বলা যেতে পারে অক্সিডেন্টালিস্ট, আরেক পক্ষকে অরিয়েন্টালিস্ট। তবে আমরা সব পক্ষই ভাবি আমাদের মূল্যবোধ ও রীতিনীতি সবই সঠিক ও উন্নত।
একদা বিধবা বিবাহের পক্ষে কিম্বা সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক পরিবর্তন করতে গিয়ে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে পর্যন্ত নিজ সমাজের রক্ষণশীল লোকদের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অবশ্য তাঁদের মানবিক দৃষ্টিকোণই পরিশেষে জয়লাভ করে। আজ সতীদাহ প্রথা ঘৃণ্য ব্যবস্থা বলে সমাজে সর্বজনস্বীকৃত। অথচ এক সময় সমাজসংস্কারকে মেরে ফেলার চক্রান্ত পর্যন্ত হয়েছিল। একইভাবে খ্রিস্টান সমাজেও বিখ্যাত যুক্তিবাদী বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে মেরে ফেলা হয়েছিল। কেননা, তাঁর পৃথিবী সূর্যকে পরিক্রমা করার তত্ত্বটি বাইবেল বিরুদ্ধ ছিল। আজকের খ্রিস্টান সম্প্রদায় সেই হত্যাকে ঘৃণ্য কাজ বলেই মনে করে।
আশ্চর্যের বিষয়, আধুনিক বিজ্ঞানের সব সুবিধা যেভাবে আমরা সানন্দে ভোগ করছি, সেভাবে বিজ্ঞান -মনস্কতার আধারে নিজেদের প্রাচীন রীতিনীতিগুলোর সময়োপযোগী বিচার করছি কোথায়? এক সময় হিন্দুদের মধ্যে হিজাবের মতো লম্বা ঘোমটা প্রথা বাধ্যতামূলক ছিল। সেটা শুরু হয়েছিল মোগল যুগে, বাদশাহদের নারী-লালসার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে। কিন্তু প্রাচীন ভারতের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে এরকম ঘোমটা প্রথা ছিল না। মোগল যুগের অবসান হলে ঘোমটা প্রথার রেওয়াজটাও সমাজে ধীরে ধীরে কমে আসে।
প্রাচীন ভারতে নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা ছিল। বিবাহে মেয়েদের পাত্র নির্বাচনের অধিকার ছিল, স্বয়ংবর সভার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের সেই স্বাধীনতা চলে গেল। সেটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। একইভাবে একসময় নারী শিক্ষাও সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সময়ের আহ্বানে নারী শিক্ষা আবার শুরু হলো। যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেরিতে হলেও ভারতের একাংশ প্রগতিশীল মুসলমান বুদ্ধিজীবী নারীশিক্ষায় সামিল হলেন। কিন্তু তাঁদের বেশভূষায় ছিল প্রগতিশীলতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply