ভাগ্যেশ্বর বাবু : স্বমহিমায় ভাস্বর
রত্নদীপ দাস (রাজু)
সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী বদলায়। সেই সাথে বদলে যায় মানুষ নামক সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব ও তাঁর অস্তিত্ব। হইজগত থেকে বিদায় নেওয়ার সাথে সাথে সেই জায়গা পূরণ করে নেয় অন্য কেউ। এটাই প্রকৃতির লীলা বা খেলা। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের নাম, কীর্তিও বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মৃত্যুর বহুদিন পরও হারিয়ে যান না। তাঁদের স্থলাভীষিক্ত অন্য কেউ হতে পারে না। তাঁরা নব নব প্রজন্মের মধ্যে বেঁচে থাকেন স্বমহিমায়। তেমনি একজন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব ভাগ্যেশ্বর বাবু (১৯২১-২০০৪)।
পোষাকি নাম ভাগ্যেশ্বর দাশ, কিন্তু পরিচিত মহল ও নবীগঞ্জ উপজেলাবাসী সহ আশেপাশের এলাকার মানুষের কাছে ‘ভাগ্যেশ্বর বাবু’ এই নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ভাগ্যেশ্বর বাবু অবিভক্ত ভারত বর্ষের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার নবীগঞ্জ থানার মুক্তাহার গ্রামে ‘বাবুর বাড়ি’ নামে খ্যাত সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২১ সালে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা বঙ্ক চন্দ্র দাশ (১৮৮৩ – ১৯৬৪; ৪ আষাঢ় ১৩৭১ বঙ্গাব্দ) ও মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী দাশ। বাবু বঙ্ক চন্দ্র দাশ ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ও হবিগঞ্জ মহকুমার ৩৯ নম্বর সার্কেলের সরপঞ্চ এবং পিতামহ ব্রজনাথ দাশ ছিলেন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁরা তিন ভাই ও তিন বোন, যথাক্রমে- (১) ভাগ্যেশ্বর দাশ, (২) মতিলাল দাশ, (৩) ভূপতি দাশ (টকি) ও (৪) কাদম্বিনী দাশ (কাঁদু)। তিনি নবীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নবীগঞ্জ জে,কে হাইস্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। ভাগ্যেশ্বর বাবু যে সময়ে নবীগঞ্জ জে,কে হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন, সে সময়ে জে,কে হাইস্কুলই ছিল এই অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় তুল্য। নবীগঞ্জের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো মূলত হাইস্কুলকে কেন্দ্র করেই। আর সে কারনেই তিনি ছাত্রাবস্থায়ই সম্পৃক্ত হন নবীগঞ্জের সাংস্কৃতিক সহ সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর নেতৃত্ব দানকারী গুণাবলি ও বহুমাত্রিক প্রতিভা ফুটে ওঠে এবং পূর্বজদের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অনেকটাই সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হন।
জীবনাচারে তিনি ছিলেন অনন্য সামন্ত, সাহসী, দৃঢ়চেতা, পরোপকারী, ন্যায়বিচারক ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পড়তেন ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা পায়জামা, কখনো কখনো সাদা চকচকে ধুতি। পড়াশোনার পাঠচুকিয়ে তিনি পৈত্রিক বিশাল ভূ-সম্পত্তি ও ইটের ভাটা দেখাশোনার কাজে মনোনিবেশ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষি জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের কর্মসূচীর আলোকে নিজেদের জমিতে এর প্রয়োগ করেন এবং লবন ও কেরোসিন ছাড়া সবকিছুই যে, এই মাটিতে উৎপাদন করা সম্ভব তার প্রচেষ্টা করেন। অবসর সময়ে পারিবারিক পাঠাগার থেকে বই/পত্রিকা পড়তেন। বিকেল বেলায় বসতেন কাছাড়ি ঘরে। সেখানে এলাকার লোকজন বিভিন্ন সমস্যাবলী তুলে ধরতেন তাঁর কাছে। তিনিও সে সব সমস্যাবলী শুনে সমাধানে ব্রতী হতেন। ভাগ্যেশ্বর বাবু যে কোনও বৈঠক বা টেবিল টকে ছিলেন অপ্রতিদ্ধ্বন্ধী। বড়ো বড়ো বিচার-সালিশ কিংবা আলোচনা সভায় তাঁর বজ্রকন্ঠের বক্তব্য পিনপতন নীরবতায় শুনতেন উপস্থিত লোকজন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথামালা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত মোহিত করতো সবাইকে। কঠিন পরিস্থিতিতেও কঠোর সিদ্ধান্ত দিতে তিনি পিছপা হতেন না। রাষ্ট্রীয় কোন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত না হয়েও তাঁর শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়ে ছিল।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্তির ফলে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ অভিজাত হিন্দু পরিবার নিজেদের পূর্ব পূরুষের ভিটে ত্যাগ করে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্যে চলে যান বা চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁদের পরিবার এ মাটিতেই রয়ে যান। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং ১৯৫৫ সালে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি চর্চায় ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ গঠিত হলে তিনি আওয়ামীলীগের একনিষ্ঠ সমর্থক হন। ৬৬’র ছয়দফায় জনমত গঠনে কাজ করেন। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবিগঞ্জে রাজনৈতিক সফরে আসলে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষাত লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের (নবীগঞ্জ-বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে কর্নেল এম এ রব এবং প্রাদেশিক পরিষদের (নবীগঞ্জ) আসনে ইসমত আহমেদ চৌধুরীর পক্ষে নিজ এলাকায় গণজোয়ার সৃষ্টি করেন। ইসমত আহমেদ চৌধুরীর (সাবেক সংসদ সদস্য) সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নির্বাচনের পর সারাদেশ স্বাধীকারের চেতনায় জ্বলে উঠলে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ গ্রহন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। একটা সময় দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি নবীগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ছিলেন নবীগঞ্জের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বাবা এলাকার সাবেক সরপঞ্চ এবং তাঁদের পরিবারের আরেক কৃতি সন্তান ডা. কুটিশ্বর দাশ (কুটিশ্বর বাবু) ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (১৯৬৭-১৯৭২) (তাঁর কাকাত ভাই)। তাই সঙ্গত কারণেই সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের জন্য নবীগঞ্জের রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজনের যাতায়াত ছিল তাঁদের বাড়িতে। সেই সকল গুণীজনদের মধ্যে অন্যতম- বাবু প্রভাত মোহন ঘোষ (শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাউসা ইউনিয়ন, গ্রাম : দৌলতপুর), জমিদার বরদা চরণ পুরকায়স্থ (জন্তরী পরগনার জমিদার), বাবু শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (জমিদার বিধুুবাবু; চেয়ারম্যান, নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, গ্রাম : গুজাখাইড়), জনাব আব্দুল আজিজ চৌধুরী (শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন সংসদ সদস্য, গ্রাম : চরগাঁও), জনাব ইসমত আহমেদ চৌধুরী (সাবেক সংসদ সদস্য, গ্রাম : মোস্তফাপুর), বাবু লাবন্য কুুমার চৌধুরী (চেয়ারম্যান, করগাঁও ইউনিয়ন, গ্রাম : বড়সাখোয়া), ডা: মিম্বারুর রহমান চৌধুরী (চেয়ারম্যান, নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, গ্রাম : রাইয়াপুর), জনাব আজিজুর রহমান চৌধুরী ছুরুক মিয়া (চেয়ারম্যান, বড় ভাকৈর ইউনিয়ন, গ্রাম : বড়ভাকৈর), বাবু মহেন্দ্র কুমার দাশ রায় (সরপঞ্চ, গ্রাম : জগন্নাথপুর), বাবু চারু চন্দ্র দাস (শিক্ষাবিদ; সভাপতি, নবীগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগ, শান্তি পাড়া, নবীগঞ্জ), বাবু বিকাশ পুরকায়স্থ (জন্তরী পরগনার সাবেক জমিদার), জনাব হীরা মিয়া (হবিগঞ্জ লোকাল বোর্ডের সদস্য, গ্রাম : রাজনগর), বাবু ক্ষেত্রমোহন রায় চৌধুরী (হবিগঞ্জ লোকাল বোর্ডের সদস্য, গ্রাম : ফতেপুর), বাবু জগত চন্দ্র চৌধুরী (জগত সরকার, গ্রাম : মাকালকান্দি, হবিগঞ্জ লোকাল বোর্ডের সদস্য), জনাব আবদুস সাত্তার মধু মিয়া (ভাইস-চেয়ারম্যান, করগাঁও ইউনিয়ন, গ্রাম : ছোট সাখোয়া), ডা: আব্দুল জব্বর (গ্রাম :রাজনগর), ডা: বিহারি লাল দাশ (কিংবদন্তী প্রতীম চিকিৎসক, গ্রাম : শিবপাশা), বাবু কাশীনাথ দাশ তালুকদার (বিশিষ্ঠ সমাজসেবক, জগন্নাথপুর উপজেলা, গ্রাম : মেঘারকান্দি), বাবু নিবারন চৌধুরী (নিবারন বাবু, চেয়ারম্যান, করগাঁও ইউনিয়ন, গ্রাম : বড় সাখোয়া), বাবু প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরী (বিশিষ্ট সমাজসেবক, গ্রাম : দুর্গাপুর), বাবু ননীগোপাল গোস্বামী (রিলিপ চেয়ারম্যান-১৯৭২, করগাঁও ইউনিয়ন, গ্রাম : জন্তরী) প্রমুখ বরেণ্যজন।
ভাগ্যেশ্বর বাবু সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে যখন অগ্রসরমান, ঠিক তখনই তাঁর জীবনে ঘটে যায় এক বিষাদময় ঘটনা, যা তাঁর জীবনকে অমানিশার অন্ধকারে ডেকে দেয়। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ভানু লাল দাশ (একাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত) অকস্মাৎ মৃত্যু বরন করেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর বিবাহ যোগ্য কন্যা ও দ্বিতীয় পুত্র ভবতারণ দাশ ছানু (দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত) মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। যা ভাগ্যেশ্বর বাবুর জীবনকে উলট-পালট করে দেয়। যা বিপর্যস্থ করে তাঁর পারিবারিক, সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় জীবনকে। আর তা না হলে যশস্বী ভাগ্যেশ্বর বাবুকে হয়তো নবীগঞ্জবাসী আরো অনন্য রূপে পেতেন।
ভাগ্যেশ্বর বাবু ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, সমাজ চিন্তক, সফল কৃষক, ন্যায়পরায়ণ বিচারক, সমাজসেবক, দেশপ্রেমিক, পাঠক, মানবহিতৈষী, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন কিংবদন্তি প্রতীম ব্যক্তিত্ব। ২০০৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ৮৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্ব। পারিবারিক শ্মশান ঘাটে পিতা-মাতার শ্মশান মন্দিরের পাশেই তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর পূণ্য স্মৃতির প্রতি উত্তরপ্রজন্মের অতল শ্রদ্ধা রইলো।
লেখক : সম্পাদক, পাঠাগার বার্তা।
Leave a Reply