শচীন্দ্র লাল সরকার : উত্তর প্রজন্মের আদর্শ
রত্নদীপ দাস (রাজু)
নির্লোভ ও দানশীল মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে কম হলেও একেবারে বিরল নয়। এই ধরাধামে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম হয়, যাঁরা দেশ ও মানুষের কল্যাণে জীবনের সমস্ত অর্জিত সম্পদ দান করে সমাজ সভ্যতা বিকাশে কাজ করেন। শ্রদ্ধেয় শচীন্দ্র লাল সরকার (১৯৩৬-২০২০) সেই বিরল মানুষদেরই একজন। তিনি যা কিছু করেছেন প্রতিদানে কিছু পেতে নয়, নিষ্কাম ভাবেই করেছেন। আর সে কারনেই তিনি আমাদের আদর্শ।
শচীন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই হবিগঞ্জ জেলা জুড়ে এর সুবাতাস বইতে শুরু করে। আমাদের নিজ উপজেলা নবীগঞ্জও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের বাড়ি নবীগঞ্জ কলেজ ও নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের অনতি দূরে মুক্তাহার গ্রামে। আমার বড় বোন, গ্রামের ছাত্র-ছাত্রী এমনকি আমাদের বাড়ি সহ গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থেকে বহু শিক্ষার্থী নবীগঞ্জ কলেজে পড়াশোনা করে। কিন্তু বাবা ঠিক করলেন আমাকে ভর্তি করবেন শচীন্দ্র কলেজে। এর কারণ প্রথমত, শচীন্দ্র কলেজে নতুন কলেজ হওয়ায় পড়াশোনা মান ভালো। দ্বিতীয়ত, ছাত্র রাজনীতি মুক্ত। তৃতীয়ত, কলেজের অধ্যক্ষ হরেকৃষ্ণ রায় মহাশয়ের সাথে বাবার সুসম্পর্ক [আমার বাবা প্রয়াত রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক) মহাশয়ের সাথে হরেকৃষ্ণ রায় স্যারের সম্পর্ক ছাত্রজীবন থেকেই। কারণ তিনি আমাদের প্রতিবেশী গ্রামের এবং বাবা ও স্যার একই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন] । অবশেষে বাবার ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে। ক্লাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই কলেজ প্রতিষ্ঠাতাকে দেখার এক অদম্য আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে অবশ্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি আমাকে। একদিন কলেজ টাইমে চলে আসলেন তিনি। পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়া ষাটোর্ধ প্রৌঢ়। হাতে কালো গল্লা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মুখে স্মিত হাসি। তাঁর সৌম্য দর্শন আমাকে চমৎকৃত করে। দেখা মাত্রই নমস্কার দিলে তিনি প্রত্তোত্তর করেন। তিনি কলেজে আসলে তাঁর সাথে থাকতেন সর্বক্ষণের ছায়া সঙ্গী মো. মোছাব্বির চৌধুরী (ব্যক্তিগত সহকারী)। কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রত্যেকের সাথে ছিলো তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। কলেজের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গুলিতে তিনি নিজে তত্ত্বাবধান করতেন। কলেজের প্রাকৃতিক পরিবেশ আকর্ষনীয় করতে তিনি বনজ, ফলজ, ঔষধী, ফুলের গাছ রোপণের নির্দেশ দিতেন। আমি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁর সাথে কোনও আলোচনা হয় নি। পাশ করার বেশ কয়েক বছর পর ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর কথা মনে পড়ে। ফোন করি কলেজের আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক গৌতম সরকার মহাশয়কে। তিনি আমাকে বললেন, “মধুমিতা ক্লোথ ষ্টোরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে।” আমি যথারীতি স্যারের দেওয়া সময়ে সেখানে পৌঁছি। কলেজের প্রাক্তণ ছাত্র পরিচয় দিয়ে প্রণাম করলে তিনি ভীষণ খুশী হন। আর উপহার হিসেবে আমার সম্পাদিত বই দিলে তিনি আনন্দিত হন ও আমাকে আপ্যায়ণ করেন। ঐ দিন আলোচনা পর্বের পর তাঁর সাথে কয়েকটি ছবি উঠি। শিক্ষানুরাগী এই মহান ব্যক্তি বিগত ২২ মে ২০২০ ইংরেজি তারিখে পরলোক গমন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে তাঁর জীবন ও কর্মের কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করার সীমিত প্রয়াস আমার এই নিবন্ধ।
শচীন্দ্র লাল সরকার অবিভক্ত ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা শহরের ঘাটিয়ায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন এক কীর্তিলগ্নে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবা সদয় চাঁদ সরকার ও মা নীরদাময়ী সরকার। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যেে তিনি জ্যৈষ্ঠ্য। অষ্টম শ্রেণি পাশ করে অর্থাভাবে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কিশোর বয়সেই তাঁকে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়। কর্ম জীবন শুরু হয় দোকান কর্মচারী হিসেবে। আর্থিকভাবে গরীর হলেও সততার কোন ঘাটতি ছিল না তাঁর। তাই কয়েক বছর পর সামান্য পূঁজি নিয়েই “স্বদেশ বস্ত্রালয়” নামে পোষ্ট অফিস সংলগ্ন স্থানে দোকান খুলে তাঁর ব্যবসায়ী জীবনের যাত্রা শুরু করলেন। আর এই পর্বের যাত্রায় সততার পাশাপাশি তাঁর সঙ্গী ছিলো দৃঢ় মনোবল ও কঠোর পরিশ্রম। ধীরে ধীরে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমনি সময়ে বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের জানমাল ও ধনসম্পত্তির যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, শচীন্দ্রবাবুর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও শারীরিক ও আর্থিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আবার নতুন করে জীবন সংগ্রাম শুরু করলেন। চলমান ব্যবসা না থাকলেও অভিজ্ঞতা, সুনাম ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সামান্য পূঁজি নিয়েই ব্যবসা চালু করলেন। এভাবে কাপড়ের ব্যবসার মধ্য দিয়েই তিনি সাফল্যের শিকড়ে পৌঁছে যান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি লক্ষ্মী রানী সরকারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিশাল অর্থ-বিত্তের মালিক হলেও শচীন্দ্র দম্পতির কোন সন্তানাদি ছিলো না। তবে তিনি কখনো নিজেকে নিঃসন্তান মনে করতেন না। পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ সন্তান, রাজপথ কিংবা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই তিনি সন্তান মনে করতেন। ইচ্ছে করলেই তিনি দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি।
আর্থিকভাবে প্রাচুর্যের অধিকারী হলেও তিনি ছিলেন খুব মিতব্যয়ী। তবে জনকল্যাণে ছিলেন ঠিক উল্টো। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য দানে ছিলেন সর্বদা উদার। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি হবিগঞ্জ শহরের ঘাটিয়ায় তাঁর বাসভবন সংলগ্ন স্থানে তাঁর মায়ের নামে “নীরদাময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে হবিগঞ্জ শহরের থেকে অনতিদূরে বানিয়াচং উপজেলার নাগুড়া গ্রামের পূর্ব পাশে বালিখাল নদীর তীরবর্তী স্থানে, প্রকৃতির কোলে গড়ে তুলেন নিজের নামানুসারে “শচীন্দ্র কলেজ”। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছিরনগর উপজেলার সিংহ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন “বিজয়লক্ষ্মী হাইস্কুল”, তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী রাণী সরকার ও শ্যালক বিজয় সরকারের নামানুসারে।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ” শচীন্দ্র সরকার শিক্ষা ফাউন্ডেশন”। হবিগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন এই ফাউন্ডেশন পরিচালনা করে এর মাধ্যমে গরীর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বৃত্তি প্রদান করা হয়। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মধুমিতা কমপ্লেক্স “হৃদয়-সদয় শিক্ষা ফাউন্ডেশন” নামক রেজিস্টার্ড ট্রাস্ট গঠন করে দান করেন (হৃদায় সরকার তাঁর জ্যেঠা মহাশয় ও সদয় চাঁদ সরকার তাঁর বাবা)। তাঁর বাসভবন গৃহদেবতা শ্যামসুন্দরের নামে দান করেন।তাছাড়া তিনি হবিগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গা মন্দির, শহরের শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর আখড়ার মন্দির, ঘাটিয়ার রাধা গোবিন্দ আখড়ার মন্দির নির্মান সহ বহু ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে আজীবন দান করে গেছেন।
শুরু করেছিলাম শচীন্দ্র কলেজ দিয়ে। এ কলেজ প্রতিষ্ঠাতার সার্থক কীর্তি। কলেজকে প্রতিষ্ঠাতা নিজের সন্তান মনে করতেন। কলেজের উন্নতি কল্পে যা যা করার প্রয়োজন তার সব কিছুই করেছেন। স্যারদের বলতেন, “লেখাপড়া যেন ভালো হয়, রেজাল্ট যেন ভালো হয়। ” একজন স্বল্প শিক্ষিত মানুষ সমাজকে আলোকিত করতে, উচ্চশিক্ষার প্রসার কি-না করেছেন? তাঁর এই আদর্শ যদি আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা অনুসরণ করতেন, তাহলে আজকের দিনে মহামারি করোনার ত্রান নিয়ে দুর্নীতি শচীন্দ্রবাবুদের দেখে যেতে হতো না। যারা বিশ্বব্যাপী মহামারীর এই দুর্দিনে গরীবের ত্রান নিয়ে দুর্নীতি করছে, তারা কোন না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। আর আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে শচীন্দ্রবাবুদের মতো দানশীল ব্যক্তিদের পরিশ্রম লব্ধ অর্থ দিয়ে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা গরিবের ত্রান নিয়ে দুর্নীতি করবে জানলে হয়তো এদেশের শচীন্দ্রবাবুরা শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে বসতেন না। তিনি কলেজের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই আসতেন। একদিন একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন- “প্রতিটি মানুষের মধ্যে আত্ম সমালোচনা ও বিবেকবোধ থাকা উচিত।” তাঁর এই উক্তিটি আজ বারবার মনে পড়ছে। আজকের অবক্ষয়ের দিনে আমাদের সবার বিবেক জাগ্রত হলেই কেবল আমাদের জাতীয় মুক্তি সম্ভব।
তিনি সাধারণ জীবনাচারে অভ্যস্থ ছিলেন। উচ্চাভিলাস তাঁর কখনো ছিলো না। পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবনে মিতব্যয়ীতার পরিচয় দিয়েগেছেন। পড়তেন পাঞ্জাবির সাথে পায়জামা, কখনো ধুতি। আহার করতেন নিরামিষ। তাঁর সহধর্মিণী লক্ষ্মী রাণী সরকার ছিলেন চিন্তায় ও মননে তাঁর আদর্শের সহযাত্রী। বিগত ২২ মে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ রোজ শুক্রবার সকাল ৬ ঘটিকায় ৮৪ বছর বয়সে মহাপ্রয়াণ ঘটে এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের। বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের সামনে যখন আদর্শ ব্যক্তিত্বের অভাব, তখন তাঁর প্রস্থান এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করবে। আর এই ক্ষতি পূরণ হতে পারে আদর্শ ও কর্মময় পথ অনুস্মরণের মধ্য দিয়ে। তিনি বেঁচে রইবেন তাঁর মহৎ কীর্তি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শিক্ষা বিস্তারের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে, তরুণ প্রজন্মের আদর্শ হয়ে। তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে উত্তর প্রজন্মের অতল শ্রদ্ধা।
লেখক : শচীন্দ্র কলেজের প্রাক্তন ছাত্র; সম্পাদক ও প্রকাশক, পাঠাগার বার্তা।
Leave a Reply