লিয়াকত হোসেন খোকন
১৯৬৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পিরোজপুরের রিজার্ভ পুকুর পাড়ের শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে এক ক্লাসমেটের চক্ষে পড়েছিলাম। সে বললো, তুই শহীদ মিনারে এসেছো, স্যারকে এখনই গিয়ে বলবো। সেই যুগে শহীদ মিনারে আসা নিষিদ্ধ ছিল। কলেজের দু’চারজন ছাত্র ছাড়া কেউই শহীদ মিনারে আসার সাহস দেখাতে পারত না। আইনশৃংখলা বাহিনী নজরদারি রাখত, কে বা কারা শহীদ মিনারে এসেছে ফুল দিয়েছে – তাদের নামে পরে মামলাও হয়ে যেত। পরের দিন স্কুলের মাষ্টারের হাতে মার খেয়েছিলাম। স্কুলের মাষ্টার মশাই আমার পিঠে বেত্রাঘাত করতে করতে বলেছিলেন, ” রাখ একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটাচ্ছি। স্কুল ছাড়া করবোই তোকে.. …”। কি করে ভুলি সেই দিনের কথা?
ভাষা, আমাদের ভালবাসা। ফাল্গুন আসতেই দরজায় একুশের টোকা। একুশে এ এক ব্যতিক্রমী ভোর। একুশে ফেব্রুয়ারি যখন এলই, তখন গোটা চারেক কথা শুধাই। বলি, এতদিন কোথায় ছিলেন? হ্যাঁ আপনি এই যে একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষাকে ছেড়ে এতটা দিন? সেই ফেব্রুয়ারিতে দেখা হয়েছিল। আর মার্চ থেকে জানুয়ারি – এগারোটা মাস দেখা নেই। কোথায় যে থাকেন এতদিন ভুলে! জানি আপনি বড় একটা সামলাচ্ছেন, ঢাকা -চট্টগ্রাম -রাজশাহী -সিলেটে। তাই কি ভাষার দিকে আর তাকানোর সময় কোথায় আপনার। এ পর্যন্ত ক’টা একুশ হাতে পেলেন? খুব কম তো নয়। কিন্তু ফলশ্রুতি? কতটুকু? কতখানি? তাই বুঝি চারিদিকে চোখে পড়ে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড। ইংরেজি প্রীতি বলে পথেঘাটে চোখে পড়ে লন্ডন রেস্টুরেন্ট, আমেরিকান রেস্টুরেন্ট নামে কত কি। দিনের পর দিন মিছিল যায়, বিদেশি ভাষায় স্লোগান দেয় জিন্দাবাদ -জিন্দাবাদ; নারায়েতকবির।
একুশ হচ্ছেটা কী? হবেটা কী আবার। নাগিনীদের যে কাজ সেটাই তারা করছে। ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। আর তাতেই দু’একদিনে নাকি একটি ভাষা ঝরিতেছে, মরিতেছে। কথা ভাষাটাও, শোক শব্দটাও বোধহয় মরতে বসেছে। আবার ক’টা ভাষা তো বড়ও হচ্ছে। প্রশ্ন, বেড়ে উঠবে কবে? হয়ে থাকছে বেঁটে, অপুষ্ট। তাই জুতসই ফুড দরকার। সুতরাং একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষামঞ্চে আজই একটা কর্মসূচি। দেরি নয়, মঞ্চ সাজাতে হবে – মফস্বলে শহরের মেয়র হবে প্রধান অতিথি, কয়েকজন কাউন্সিলর বিশেষ অতিথি। শোনা যায়, তাদের অনেক অপকীর্তির কেচ্ছা কাহিনী। দেখুন মেলে পাঁচ নয়ন। কাকে দেখাবেন? কাকে আবার। যাকে ভালবাসি তাকে। ভাষাকে। ভাষার সঙ্গে ভূখণ্ডকেও। ওই দেখুন – ফণীমনসার ঝোপে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে, জাম -বট -কাঁঠালের -হিজলের ছায়া। কেয়াবনের ঝোপে ওই দেখুন জোনাকির মিটিমিটি, আছে নীল সন্ধ্যা এক, মনে হবে কেশবতী কন্যা এক এসেছে ঐ নীল আকাশে। কোথায় গাড়ি আপনার? আমেরিকান এমবাসির কাছে। আবার কেউ বলে, পাকিস্তান এমবাসির ওখানে। আপনার ভাষা? আজ বাংলা। কালকে হয়ে যাবে উর্দু নয়তো ইংরেজি। তাই তো বাড়িঘর রয়েছে কানাডায়। ব্রিটিশদের পা ছুঁয়ে সালাম জানাই।
আসুন ভাষায় – ওদের যতই অনুরোধ করি ওরা বাংলা ভাষায় ফিরে আসবে না। ওরা গাইবে না, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। ওরা জিন্দাবাদী, মওদুদীবাদী। যায় না শহীদ মিনারে ফুল দিতে। ভাষা কি তবে ধর্মের আড়ালে লুকিয়ে আছে? ভাষা -কর্তারা কী বলবেন?
আমরা বাংলাদেশের মানুষ – আমরা পেয়েছি সোনার বর্ণমালা। নক্ষত্র পুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে যে আছে কত বড় বড় সভায়, সে আমাদেরই ভাষা। আজন্ম সহচর। একদিন মুখের ভাত ফেলে মুখের ভাষাকে বাঁচাতে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক ছুটে ছিল রণক্ষেত্রে। ঢাকার রাজপথ । ওরা বলে গিয়েছিল, ‘ পান্তা ভাত বেড়ে রেখো, কাঁচা মরিচ -পিঁয়াজ হলেই চলবে। ফিরে এসে খাব – না এলে মাগো ভেবো না। ‘ বরকতের মা ভেজেছিল বিন্নি ধানের খই, উড়কি ধানের মুড়কি। কিন্তু বরকতের ওসব চাই না, চাই ভাষা -মাকে। বরকত বলেছিল – “ওরা তোমার কোলে শুয়ে, গল্প শুনতে দেবে না। বলো মা, তা কি হয়?” মায়ের জন্যে এতখানি? আমরা কি এর মূল্যায়ণ করতে পেরেছি? বোধহয় পারিনি। মুর্শিদাবাদে সন্তান ছিলেন বরকত।
তাও কেউ স্মরণ করতে পারবেন না বোধহয় আজ।
বরকতের জন্মস্থান চোখে দেখেছি, বরকতের বাড়িঘরও দেখেছি – গিয়েছি ভাষা শহীদ বরকতের টানে।
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস পালন করলেও বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মমত্ব আজও যেন কমই।
ব্যক্তিগতভাবে এক মরমী মানব আমি। এই সত্তর বয়সেও আমার সেই মরমী মন নিয়ে তাকিয়ে থাকি মাতৃভাষা দিবসের দিকে। একুশে ফেব্রুয়ারি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শহীদ মিনারে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে তাকে বরণ করে নিতে হবে -নিতেই হবে।
সেই ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের তরুণরা প্রাণ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই – স্লোগান দিয়ে। সেই দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। সারা বিশ্ব এই দিনটিকে মান্যতা দিয়েছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস রূপে। দেখা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি পাঁচজন শহীদকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। আন্তর্জাতিক এই ভাষা দিবসের কর্মকাণ্ডের মধ্যে উনিশে মে শহীদদের, ও অন্যান্য স্থানের ভাষা -সৈনিকদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কথাও সবাই মনে রাখেন না। অনালোচিত থেকে যান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভাষাসৈনিকেরা।
এ প্রসঙ্গে একটু স্মৃতিচারণ না করলেই যে নয়, ১৯৬৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পিরোজপুরের রিজার্ভ পুকুর পাড়ের শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে এক ক্লাসমেটের চক্ষে পড়েছিলাম। সে বললো, তুই শহীদ মিনারে এসেছো, স্যারকে এখনই গিয়ে বলবো। সেই যুগে শহীদ মিনারে আসা নিষিদ্ধ ছিল। কলেজের দু’চারজন ছাত্র ছাড়া কেউই শহীদ মিনারে আসার সাহস দেখাতে পারত না। আইনশৃংখলা বাহিনী নজরদারি রাখত, কে বা কারা শহীদ মিনারে এসেছে ফুল দিয়েছে – তাদের নামে পরে মামলাও হয়ে যেত। পরের দিন স্কুলের মাষ্টারের হাতে মার খেয়েছিলাম। স্কুলের মাষ্টার মশাই আমার পিঠে বেত্রাঘাত করতে করতে বলেছিলেন, ” রাখ একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটাচ্ছি। স্কুল ছাড়া করবোই তোকে.. …”। কি করে ভুলি সেই দিনের কথা? বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষের কাছে, সবরকমের ভাষার মানুষের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস। অবশেষে বলি, মাতৃভাষাকে সন্মান ও শ্রদ্ধা করি, প্রাণের ভেতরে রাখি -রাখবই।
লেখক : প্রাবন্ধিক; রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply