ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে : অবিভক্ত ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ
লিয়াকত হোসেন খোকন
ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ হলেন ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে। তাঁর পরিচালিত
রাজা হরিশ্চন্দ্র মুক্তি পেয়েছিল ১৯১৩ সালের ৩মে। ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্র প্রেমিদের কাছে দাদাসাহেব ফালকে নামে সমধিক খ্যাত।
ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে ১৮৭০ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের নাসিক জেলা সদর থেকে ১৮ মাইল দূরে ত্রিম্বকে একটি বর্ধিষ্ণু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন বম্বের এলফিনস্টোন কলেজের অধ্যাপক। ফালকে ছোটবেলা থেকে থিয়েটার, ছবি আঁকা, ম্যাজিক ইত্যাদি সব রকম শিল্পকলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বম্বের জে. জে. স্কুল অব আর্টস এবং বরোদার কলাভবনে ছবি আঁকা শিখেছিলেন। পরে তিনি ইউরোপ থেকে ছবি তোলা আর ব্লক তৈরির ব্যাপারে শিক্ষা নিয়ে বম্বেতে ফিরে আসেন।
১৯১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে ইংল্যান্ডে গিয়ে একটি উইলিয়ামসন ক্যামেরা, একটি পারফোরেটিং মেশিন, একটি প্রিন্টিং মেশিন আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসেন। বম্বেতে এসে শুরু হয় তাঁর ছবি তোলা অর্থাৎ বায়োস্কোপ তোলার পরীক্ষা -নিরীক্ষা। প্রথমে একটা চারাগাছের ক্রমবর্ধমান জীবন নিয়ে তিনি মাত্র ৫০ ফুট দীর্ঘ ফিল্মে চিত্রায়িত করেছিলেন।
এর কিছুদিন পরেই দাদাসাহেব ফালকে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ছবিটি তৈরি করেন – এর দৈর্ঘ্য ছিল ৩৭০০ ফুট। ছবি তৈরি করতে ৮ মাস সময় লেগেছিল। এই ছবির নায়িকা ছিলেন আন্না সলুঙ্কে। সে নারী ছিল না, সে ছিল পুরুষ। তাঁর বয়স তখন ষোল কি সতেরো ছিল। রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এই আন্না সলুঙ্কে।
রাজা হরিশ্চন্দ্রের জীবন কাহিনী নিয়ে রাজা হরিশ্চন্দ্র ছবির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে সময় লেগেছিল ৮ মাস। নির্বাক যুগে রাজা হরিশ্চন্দ্র ছবিটি অসম্ভব খ্যাতি পেয়েছিল। ছবির প্রযোজক ও পরিচালক ধোন্দিরাজ গোবিন্দ ফালকের আরেক নাম দাদা সাহেব ফালকে। আর এই নামেই তিনি পরিচিত। তিনি ছবিতে পাত্র-পাত্রী নিতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। মঞ্চের পেশাদার অভিনেতা অভিনেত্রী সিনেমাকে তখনও ভাল বুঝতে শুরু করেনি। পতিতাদের ডেকেও সিনেমায় আনতে পারলেন না। বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিনেতা জুটলো, কিন্তু অভিনেত্রী মিলল না। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজির পর বম্বের এক মাঝারি মানের হোটেল থেকে রান্নার সাহায্যকারী এক নাদুস নুদুস সুন্দর কিশোর ছেলেকে ছবির নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তার নাম সলুঙ্কে। আর দাদা সাহেব ফালকের ছেলে বালচন্দ্র শিশুশিল্পী হিসাবে অভিনয় করেছিলেন। তিনিই উপমহাদেশের প্রথম শিশুশিল্পী ছিলেন। সিনেমার অভিনয়ে ছিলেন- দত্তাত্রেয় দামোদর দারকে, আন্না সলুঙ্কে, বালচন্দ্র এবং আরও অনেকে। সিনেমার কাহিনী রণছোরবাঈ উদয়রাম। রাজা হরিশ্চন্দ্র উপমহাদেশে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। এরপর তিনি ‘ভষ্মাসুর মোহিনী’ আর ‘সাবিত্রী’ নামে আরও দু’খানা ছবি নির্মাণ করেন।
১৯১৪ সালে দাদাসাহেব ফালকে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ‘ভষ্মাসুর মোহিনী’ আর ‘সাবিত্রী’ ছবি তিনখানা নিয়ে ইংল্যান্ডে যান, সেখানে ছবি দেখান এবং ছবিগুলি সমাদর লাভ করেছিল।
দাদাসাহেব ফালকে ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৩ টি ছবি তৈরি করেছিলেন। তার মধ্যে
‘লঙ্কা দহন’ ছিল তাঁর শেষ ছবি।
চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি ‘হিন্দুস্থান ফিল্ম কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন।
এই কোম্পানির অফিস তিনি মহারাষ্ট্র প্রদেশের নাসিকে স্থানান্তরিত করেন।
হিন্দুস্থান ফিল্ম কোম্পানির উল্লেখযোগ্য ছবি হল –
শ্রীকৃষ্ণ জন্ম এবং কালীয়মর্দন।
দাদাসাহেব ফালকে’র মেয়ে মন্দাকিনী ‘কালীয়মর্দন’ ছবিতে অভিনয় করে ভারতীয় মেয়েদের চলচ্চিত্রে যোগ দেবার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
কালীয়মর্দন ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১৯ সালে।
দাদাসাহেব ফালকে তাঁর সারা জীবনে সর্বমোট ১২০ খানা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করেছিলেন।
তাঁর নির্মিত শেষ ছবি ‘গঙ্গাবতরণ’। এটি মুক্তি পায় ১৯৩৭ সালে।
দাদাসাহেব ফালকে’র মৃত্যু ১৯৪৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মহারাষ্ট্র প্রদেশের নাসিকে।
দাদাসাহেব ফালকে’র নির্মিত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল –
১৯১৩ সালে – রাজা হরিশচন্দ্র। ভষ্মাসুর মোহিণী।
১৯১৪ সালে – সাবিত্রী।
১৯১৭ সালে – লঙ্কা দহন। সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র।
১৯১৮ সালে – শ্রীকৃষ্ণ জন্ম।
১৯১৯ সালে – কালীয়মর্দন।
১৯২৬ সালে – ভক্ত প্রলহাদ।
১৯৩২ সালে – সেতু বন্ধন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক, রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Leave a Reply