বাবা : আজীবনের শিক্ষক-পথ প্রদর্শক
রত্নদীপ দাস (রাজু)
আজ অস্ত্রু সজল চোখ আর ব্যথায় কাতর মন নিয়ে লিখতে বসেছি একজন পিতার সম্পর্কে। যিনি পুত্রের জীবনে শুধু পিতাই ছিলেন না, ছিলেন- বাল্যকালের ছায়া সঙ্গী, কৈশোরের বন্ধু, আজীবনের শিক্ষক-পথ প্রদর্শক তথা একজন আদর্শিক ব্যক্তিত্ব। আর ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন উল্লেখিত প্রত্যেকটি গুণাবলীর অধীকারী। স্রষ্টার সৃষ্টির জীবদের মধ্যে একমাত্র মানুষই সর্ব শ্রেষ্ঠ। আবার একমাত্র মানুষকেই জন্ম নেওয়ার পর নতুন করে মানুষ হতে হয়। আমাকে জন্মের পর থেকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য যে ব্যক্তি ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা করেছেন জীবনভর, তিনি আমার পরম পূজনীয় পিতৃদেব স্বর্গীয় রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (অবশ্য মায়ের অবদানও অনস্বীকার্য)।
আমি ছোট বেলায় শুনেছি আমার জন্ম হওয়ার পর বাবা নাকি আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন। কারন আমার আগে আমার দুই বোন এবং দুই ভাইয়ের জন্ম হলেও ভাইয়েরা বাল্যকালেই পরলোক প্রাপ্ত হন। শৈশবেই বাবা আমাকে পরিচয় করে দেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, মাইকেল মধুসূধন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুু, মাহাত্মা গান্ধী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ মাহাত্মার জীবন ও কর্মের সাথে। আমাদের শোয়ার ঘরে এই মহতীদের চিত্রপট ও বাবার মুখের বর্ণনা বল্যকালেই আমার চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া তাঁর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমার মানস গঠনে প্রভাবক ভূমিকা রাখে।
আমার বাবা ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ, শোনেছি আমার পিতামহও ছিলেন তাই। ছাত্র জীবন থেকেই সংগীত চর্চার প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম আগ্রহ। সংগীতে পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি তিনি অভিনয়, ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও সমান পারঙ্গমতা অর্জন করে ছিলেন। তাই হারমোনিয়ম, তবলা, গিটার, বেহালা, ডোল, কুল, দোতরা প্রভৃতি বাদ্য যন্ত্রে ছিলেন পারদর্শী। আর এজন্যই এই সব বাদ্যযন্ত্রের সাথে আমার পরিচয় জন্মলগ্ন থেকেই। বাবা এই সব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করতেন, অবশ্য সাথে অন্যান্য বাদ্য শিল্পীও থাকতেন। প্রতিদিন সন্ধায় ঠাকুর ঘরে সন্ধারতী হতো, যা এখনও অব্যাহত আছে। কাজেই বাবা চাইতেন আমিও এই সব যন্ত্রের ব্যবহার ও গান গাইতে যেন পারদর্শিতা অর্জন করি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তাঁর প্রচেষ্টায় বেশ কিছু স্বরলিপি ও গান হারমোনিয়মে বাজিয়ে গাইতেও শিখি। কয়েকটা প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহন করি। কিন্তু তাঁর চেষ্টা থাকা সত্বেও পরবর্তিতে নিজেরই কারনে আর এগুনো হয়নি।
বাবা আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বৈলাকীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এবং মা স্কুলের অনতিদূরে শাখোয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সংলগ্ন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা। আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার বছর দুয়েক আগেই বাবার সাথে হেমন্ত মৌসুমে পায়ে হেটে আর বর্ষায় আমাদের গোস্তী নৌকায় করে স্কুলে আসতাম। ১২ টার পরে ১ম ও ২য় শ্রেণির ছুটির পর স্কুলের ছাত্রদের সহযোগীতায় চলে আসতাম মায়ের অফিসে। বিকলা ৪.৩০ বা ৫.০০ টা দিকে স্কুল ছুটির পর বাবা আমাকে মায়ের অফিস থেকে সাথে করে বাজারে কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতেন। এটাই ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিন। আসা যাওয়ার পথে প্রত্যেক দিন প্রতিটি মিনিট আমাকে পড়ার উপরেই রাখতেন। তখন খুব বিরক্তি বোধ করতাম। কিন্তু এর সুফলটা এখন বুঝি।
বাবা আমাকে পড়াশোনায় অনুপ্রাণিত করতে প্রায়শই উদাহরন দিতেন একসময়কার কৃতি শিক্ষার্থী তাঁর বন্ধু, অগ্রজ, অনুজদের। এই গুণীজনদের মধ্যে যতদূর মনে পড়ে সেই ব্যক্তিরা হলেন- শহীদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্ধৈপায়ন ভট্টাচার্য, নিবারণ দেব, ডাঃ সুকেশ দাস, মেজর (অব:) সুরঞ্জন দাস, প্রকৌশলী চিত্তরঞ্জন দাস, বজলুর রহমান (শিক্ষক) প্রমুখের। যাঁরা মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করে ছাত্র জীবনে যেমন অর্জন করেছেন কৃতিত্ব, তেমনি কর্ম জীবনেও সফলতা অর্জন করেন। পরিচয় করে দিতেন গুণীজনদের সাথে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবীগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা জমিদার শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু), বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জনাব আব্দুল আজিজ চৌধুরী প্রমুখ খ্যাতনামদের সাথে তাঁদের আদর্শে উজ্জ্বীবিত হতে। স্কুল ও উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটা টোনামেন্টে আমাকে প্রস্তুত করতেন। উপস্থিত বক্তৃতা, উপস্থিত অভিনয়, দেশাত্মবোধক গান, দৌড় প্রতিযোগিতায়। উপস্থিত বক্তৃতায় স্কুল ও উপজেলা পর্যায়ে কৃতিত্ব অর্জন করলেও অন্য গুলোতে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারিনি। কোন এক বিখ্যাত মনিষী বলেছিলেন- “কোন সন্তান তার পিতার মতো হয় না। অধিকাংশ হয় পিতা থেকে কম গুণ সম্পন্ন। খুবই সীমিত সংখ্যক হয় পিতার মতো। একেবারেই স্বল্প (বিরল প্রায়) সংখ্যক হয় পিতা থেকে গুণবান”। আমার বাবা এমনি এক গুণী লোক ছিলেন, যিনি গান, অভিনয়, বক্তৃতা, ফুটবল, ভলিবল, সাঁতার, দৌড়, সহ সকল ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে ছিলেন পারদর্শী। এই রকম গুণী পিতার সন্তান হয়ে আমি তাঁর গুণগুলো ধরে রাখতে আজো প্রয়াসী।
বাবা আমাকে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ক্লাস টু/থ্রী থেকেই জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বিশ্ব বিচিত্রা, আমার উপযুক্ত গল্পের বই এনে দিতেন, রেডিওতে সংবাদ ও সংসদ অধিবেশন শুনার অভ্যাস তৈরী করে দেন। পুত্রের মানসিক বিকাশের জন্য। শারীরিক গঠন শৈলী শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রাতঃকালে ঘুম থেকে তুলে শরীরচর্চা, স্নানের সময়ে নিয়মিত সাঁতারকাটা (প্রথম প্রথম নিজের পীঠেকরে সাঁতারকাটানোর স্মৃতি আমি কখনও ভুলব না) এবং বাস্তবিক জীবনযাপনের জন্য গৃহস্থলীর বিভিন্ন কাজও শেখাতেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন সময়ে নিয়ে যেতেন- সবজি ক্ষেত, ধান ক্ষেত, ঐতিহাসিক স্থান, পর্যটক কেন্দ্র, চা বাগান, পুরাতন বিভিন্ন স্থাপনা, হওর, নদী, প্রত্তত্বাত্মিক স্থান দেখতে প্রভৃতি স্থানে। নিজের জীবনের কঠিন সময় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরতেন সন্তানের চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য।
আমার বাবার জীবন ঘটনাবহুল এক সংগ্রামী জীবন। বাল্যকালে মাতৃহারা, যৌবনে পিতৃহারা, বিবাহিত জীবনে স্ত্রী বিয়োগ ও পুনরায় দ্বার গ্রহন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পর অনেকটা ভঙ্গুর আর্থিক অবস্থা থেকে উত্তোরনের চেষ্টা। সব কিছু কঠিনতম জীবন সংগ্রামের দীর্ঘতম পথ। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও তিনি নীতিভ্রষ্ট হননি, আদর্শচ্যুত হননি। সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন আজীবন। এই রকম একজন পূণ্যাত্মার ঔরসজাতক হয়ে আমি সত্যিই গর্বিত।
আমার বাবা সব সময় উপদেশ দিতেন- “কারো উপকারে না আসলেও কারো ক্ষতির কারন যেন না হই। সদা সত্য কথা বল। সত্যই ধর্ম। কখনো নীতিচ্যুত হয়ো না, স্বধর্মকে কখনো ত্যাগ করো না। তুমি যে পেশায়ই থাকো, সাধারণ মানুষ যেন উপকৃত হয়।”
আমার বাবা ছিলেন শৌখিন ও স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। খাবারের বেলায় একেবারে আপোষহীন। প্রত্যেক মৌসুমে মৌসুমি ফল বাজারে ওঠা মাত্র চড়া দামে নিয়ে আসতেন। সকাল বেলা নিজে পরিবারের সকলকে টাটকা ফল দিয়ে নাশতা করাতেন। সবসময় বাসি খাবার ছিল পরিত্যেজ্য। টাটকা সবজি, তরকারি, মাছ ছিল তাঁর প্রথম পছন্দ। দুধ, দুগ্ধজাত খাবার ও মিষ্টি খুব ভালোবাসতেন। আমার কিংবা পরিবারের অন্যান্যদেরও যে কোনও জিনিস চাওয়া মাত্র এনে দিতেন। আমার জীবনে কোন জিনিস অপূরণ রাখেননি।
আমার বাবা ছিলেন আপাদমস্তক নিরেট একজন সজ্জন ব্যক্তি। বহিরঙ্গে তাঁকে অনেক কঠুর ও রাগী মনে হলেও বাবা ছিলেন – কোমল মনের, স্নেহ ও মমত্ববোধে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। যে কোন ব্যক্তি সে আত্মীয়ই হোক কিংবা অপরিচিতজন, তাঁর কাছে আসলে তিনি সাধ্যমতো সহযোগিতা ও সৎ পরামর্শ দিতেন।
আমার বাবা আমাদের পরিবারের জন্য যেমন আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তেমনি সমাজকেও কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রজীবনে যেমন নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞানে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে দেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তেমনি কর্মজীবনে এসেও সরকারি উচ্চবেতনের চাকুরীতে যোগদানের সুযোগ পেলেও তা গ্রহন করেনি। সমাজকে সুশিক্ষার আলোয় আলেকিত করার প্রয়াসে শিক্ষকতাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহন করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক এই দুই পরিচয় তাঁর ব্যক্তিত্বকে যেমন অনন্য উচ্চতায় তুলেছিল, তেমনি আমিও এই দুই পরিচয়ের গুণান্বিত ব্যক্তির উত্তরাধীকারী হিসেবে গর্ববোধ করি।
বাবা দেখতে যেমন ছিলেন সুপুরুষ, তেমনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। সত্তোরউর্ধ বয়সেও তাঁর জীবন যাপনে ডাক্তারি কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। জীবন প্রনালী ছিল অত্যন্ত গোছানো, পরিপাটি ও মার্জিত। কিন্ত হঠাৎ ১অক্টোবর ২০১৭ ইংরেজি তারিখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক মাস মোটামুটি সুস্থ থাকলেও পরবর্তী সময়ে অবস্থা ক্রমাগতভাবে অবনতি হতে থাকলে প্রথমে প্রইভেট ক্লিনিক, তারপর সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল ও মাদ্রাজ শহরের গ্লোবাল হসপিটালসিটিতে উন্নত চিকিৎসার পরও আর স্বাবাভিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন নি। অবশেষে নিজ বাড়িতে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবনকালীন সময়ে মায়াময় পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ইংরেজি তারিখে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। বিখ্যাত জার্মান কবি নোবেল বিজয়ী টমাস মান মৃত্যুকে এভাবেই দেখেছেন-“A man’s dying is more the the sarvirrs affairs than his own.” অর্থাৎ “মৃতের জন্য মৃত্যু কোন বিষয়ই না। কিন্তু মৃত ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকে, তাদের জন্য সে অনুভূতি খুবই দুর্বহ। যা তাদের হৃদয়ে দাগকাটে আজীবন।”
আমার বাবা নেই আমি এখনো মানতে পারিনা। অথচ আমি নিজে তাঁকে মুখাগ্নী করেছি। বাবা দেহত্যাগ করলেও আমার হৃদয় জুড়ে, আমার চৈতন্য জুড়ে তিনি থাকবেন আজীবন। আমার সুখে-দুঃখে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় আমার চিরসঙ্গী হয়ে, আমার স্বর্গ হয়ে। শাস্ত্রে আছে (পিতার প্রণাম মন্ত্র) –
পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ।
পিতোরি প্রিতিমা পন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতাঃ।।
অর্থাৎ “পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে ভজন করলে সব দেবতা সন্তুষ্ট হন।” আমি আমার বাবার ভজন করতে পেরেছি কিনা জানিনা। তবে আজীবন ইশ্বরের কাছে প্রর্থনা করে যাব তাঁর পরমগতি কামনায়।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, পাঠাগার বার্তা।
Leave a Reply