ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির সংবাদ সম্মেলন-এর লিখিত বক্তব্য:
তারিখ: ২৫ সেপ্টেম্বর, বিকেল ৪ টা
স্থান: হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
সবাইকে শুভেচ্ছা।
আমরা যাঁরা হবিগঞ্জের মানুষ, তাঁদের কাছে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমাদের মধ্যে যাঁদের তাঁর বই পড়া হয়নি, তাঁরাও জানি রামনাথ আমাদের গর্বের ধন। তিনি আমাদের হবিগঞ্জের তো বটেই, বাংলাদেশের, গোটা বাংলার গর্ব।
শতেক বছর আগে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ার রামনাথ বিশ্বাস বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন ভূ-পর্যটনে। দেশে দেশে ভ্রমণ করেই ক্ষ্যান্ত হননি তিনি, বাঙালির ঘরকুনো অপবাদ ঘূচানো এই মানুষটি লিখেছেন ভ্রমণবিষয়কসহ গোটা চল্লিশেক বই।
উদার-অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী রামনাথের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। বানিয়াচংয়ের লোকজন এখনও তাদের গ্রামগুলোকে পাড়া বলে ডাকেন। ইউনিয়নগুলো নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেন। পুরো বানিয়াচং একটা গ্রাম, সেই দাবির যৌক্তিকতা ধরে রাখার জন্যই এমনটা করেন বলে আমাদের ধারণা, যে ধারণার জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। তিনি দাবি করেছিলেন, বানিয়াচং পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম।
বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রামনাথ। এরপর তাঁর বাবা বিরজানাথ বিশ্বাসের মৃত্যু হলে পড়াশোনার ইতি ঘটে। মা গুণময়ী দেবীরও অকাল মৃত্যু হয়েছিল। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে রামনাথ হবিগঞ্জে ভাণ্ডার সমিতি বলে একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার পদে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে তিনি বাইসাইকেল ও মোটর গাড়ি চালানো শিখেছিলেন।
সাংবাদিক বন্ধুরা, আপনাদের অনেকের জানা আছে, সৈনিক জীবনে ঘুরে বেড়াবার যে সুযোগ পেয়েছিলেন সেই অনুপ্রেরণায় ১৯৩১ সালের একদিন সাইকেল নিয়ে পথে নামলেন আমাদের রামনাথ বিশ্বাস। তখন তিনি সিঙ্গাপুরে চাকরি করেন, যে দেশে গিয়েছিলেন ১৯২৪ সালের শেষের দিকে। রামনাথের জীবনীকার শ্যামসুন্দর বসুর লেখা থেকে জানা যায়, সঙ্গে এক জোড়া চটি, দুটি চাদর নিয়েছিলেন। বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে একটি বাক্সে ছিল সাইকেল মেরামতের সরঞ্জাম। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিট থেকে যখন যাত্রা শুরু করেন, তখন সেখানকার বাঙালি মসজিদের সামনে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ উপচে পড়েছিল তাঁকে বিদায় জানাতে। সমবেতজনের বেশিরভাগই ছিলেন সিলেটি। তাঁরা বন্দে মাতরমের পাশাপাশি আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে কুইন স্ট্রিট মুখরিত করে তুলেছিল বলে রামনাথের জীবনীকার লিখেছেন। রামনাথ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসতেন। আপনাদের জানা আছে, ১৯৪৬ সালের গ্রেট কলকতা দাঙ্গায় নিজের জীবন বাজি রেখে বাঁচিয়েছিলেন ৩৯ জন মুসলিমের জীবন।
কুইন স্ট্রিট থেকে সেবার রামনাথ সাইকেলে করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, চীন, কোরিয়া, জাপান হয়ে কানাডায় পৌঁছান। কানাডায় তাঁকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২৯ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতা হয়ে ১৯৩৪ সালে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। সেবার বানিয়াচংয়ের সাগরদীঘির পাড়ের মাঠে, মতান্তরে সাগরদীঘি পাড়ের অদূরে এড়ালিয়া মাঠে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই সভার গল্প ঘুরেফিরে শুনতে পাবেন বানিয়াচংয়ের লোকজনের কাছে।
১৯৩৪ সালে রামনাথ দ্বিতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন। সেবার তিনি আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ব্রিটেন পৌঁছান। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডও তিনি সাইকেলে পরিভ্রমণ করেন।
সেই যাত্রায় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে লন্ডন থেকে জাহাজে মুম্বাই ফিরে আসেন। সুস্থ হয়ে ১৯৩৭ সালে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। ততদিনে রামনাথের লেখা ছাপা হচ্ছে ‘দেশ’ সাময়িকীতেও। কবিগুরু তাঁর ভ্রমণকাহিনি পড়েছেন এ কথা জেনে খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন রামনাথ।
তৃতীয়বারের যাত্রা শুরু করেন ১৯৩৮ সালে। সেবার রামনাথ বিশ্বাস আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দেন। মুম্বাই থেকে তিনি জাহাজে মোম্বাসায় পৌঁছে সেখান থেকে সাইকেল যাত্রা শুরু করেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভালো লাগেনি বলে লিখেছিলেন। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে চলে আসেন বানিয়াচংয়ে। ততদিনে ভ্রমণ সাহিত্য রচনায় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।
বন্ধুরা,
আপনারা জানেন নিশ্চয়েই, কলকাতা আর বানিয়াচংয়ে যাতায়াতের মধ্যে থাকলেও অকৃতদার রামনাথ বিশ্বাস নিজ ভিটা বানিয়াচংয়ে থিতু হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পুরোপুরি কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর মারা যান।
কলকাতায় তাঁর নামে রয়েছে ‘রামনাথ বিশ্বাস সড়ক’, অথচ নিজভূমে তিনি হয়ে গেছেন পরবাসী। বানিয়াচংয়ের ওই বাড়িটি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করা গেলে রামনাথকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে তাঁর ’দুইন্যাই’। আপনারা শুনেছেন, পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো রামনাথ নাকি বলতেন, ‘বাইন্নাচুং আমার দুইন্যা’।
বন্ধুরা, আমরা জানতে পেয়েছি, রামনাথের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির দখলদার আবদুল ওয়াহেদ মিয়া আল-বদর পরিবারের সদস্য। নিজেও এক সময় জামায়াত-বিএনপি করতেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে রীতিমতন ওয়ার্ড কমিটির সভাপতির পদও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। দলীয় পরিচয়ের জোরে রামনাথের বাড়ি দেখতে যাওয়া পর্যটক, বাইসাইকেল রাইডার ও সাংবাদিকের ওপর বিভিন্ন সময় হামলা চালিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূরসহ চার সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন দখলদার ওয়াহেদ ও তাঁর পুত্রদের হাতে। রাজীব নূরের সঙ্গে নিগৃহীতদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক মোশাহেদ মিয়া, তৌহিদ মিয়া ও আলমগীর রেজা। এঁদের ওপর হামলার মাত্র সপ্তাহখানেক আগে দেশ টিভির হবিগঞ্জ প্রতিনিধি আমির হামজা এবং এখন টিভির হবিগঞ্জ প্রতিনিধি কাজল সরকার হামলার শিকার হয়েছিলেন ওয়াহেদ গংয়ের কাছে। আমরা এই সব হামলার তীব্র নিন্দা জানাই এবং যথোপযুক্ত বিচার দাবি করছি।
বন্ধুরা,
আপনারা জানেন, আওয়ামী লীগ থেকে ওয়াহেদ বহিষ্কৃত হয়েছেন। তবে শুধু দল থেকে বহিষ্কার করা বড় কোনো সমাধান নয়। রামনাথ বিশ্বাসের বসতবাড়িটি এই দখলদারের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। ওই বাড়ির প্রায় পাঁচ একর জমির সবটুকুই এখন সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ার কথা। প্রকৃতপক্ষে সরকারই এ জমির মালিক। তাই বিস্মৃতপ্রায় ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের স্মৃতি রক্ষার দায়িত্বও সরকারের।
সাংবাদিক বন্ধুরা,
সরকার যেন আমাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়, এ কাজে আপনারাই পারেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। আমরা বিষয়টি সরকারের নজরে আনার জন্য এবার ২৭ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার বিশ্ব পর্যটন দিবসে হবিগঞ্জ থেকে সাইকেল চালিয়ে বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ায় যাচ্ছি বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণকারী রামনাথ বিশ্বাসকে স্মরণ করতে। সেই লক্ষ্যে লেখক, সাংবাদিক, সাইক্লিস্ট ও সংস্কৃতিকর্মীরা মিলে গঠন করেছি ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি। ওই কমিটির পক্ষে আমরা পর্যটন দিবসের প্রতীকী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রামনাথের বাড়িটি পুনরুদ্ধারের পর সেখানে ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের একটি বিশেষায়িত পাঠাগার এবং বাইসাইকেল মিউজিয়াম গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছি।
বাইসাইকেলে রামনাথের বাড়ির পথে যাত্রা শীর্ষক আমাদের এবারের কর্মসূচির অংশ হিসেবেই হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে আজকের এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেল চারটায় আমরা যাব বানিয়াচংয়ে। সেখানে ১ নম্বর বানিয়াচং ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে সাংবাদিক ও সুধীজনের সঙ্গে রয়েছে মত বিনিময়।
২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় হবিগঞ্জ টাউন হল থেকে রামনাথের বাড়ির পথে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা শুরু হবে। ওইদনিই সকাল ১১টায় বানিয়াচং শহীদ মিনারে বানিয়াচংয়ের সন্তান, খ্যাতিমান সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু করবেন প্রতীকী অনশন। বাইসাইকেল শোভাযাত্রা রামনাথের বাড়ি বিদ্যাভূষণ পাড়া ঘুরে এসে আমরা বিষ্ণুর অনশন ভঙ্গ করাব। এরপর বানিয়াচং শহীদ মিনারে বিকেল চারটায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বন্ধুরা,
রামনাথের বসতভিটা পুনরুদ্ধারে যে সব ভূমিকা রাখা প্রয়োজন, সরকার তা নেবে বলে কমিটি বিশ্বাস করতে চায়। তবে প্রয়োজনে আমরা নিজেরাও আইনগত পদক্ষেপ নেব। পহেলা নভেম্বর রামনাথ বিশ্বাসের মৃত্যুদিন এবং ১৩ জানুয়ারি জন্মদিবস। এ দুটি দিনই আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করব। ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশব্যাপী চলবে ‘রামনাথকে স্মরণ করি, কীর্তিমানের স্মৃতি সংরক্ষণেরাখি’ শীর্ষক জনসচেতনতামূলক নানান কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আগামী ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জেলায় জেলায় বাইসাইকেল শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য আমরা সাইক্লিস্টদের অনুরোধ করব। আমরা বাংলাদেশের সাইক্লিস্টদের কাছে আহ্বান জানাব, তাঁরা যেন ১৩ জানুয়ারি বাইসাইকেলের এই আদিগুরু রামনাথের জন্মদিনটিকে স্মরণ করে ‘রামনাথ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেন।
.
আমাদের সমস্ত কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণ। আগেই বলেছি, আমরা চাই সেখানে ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের একটি বিশেষায়িত পাঠাগার এবং বাইসাইকেল মিউজিয়াম গড়া হোক, রামনাথকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক তাঁর ‘দুইন্যা’।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক ভূপর্যটক ও লেখক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, যুগ্ম-আহ্বায়ক কবি শাহেদ কায়েস, ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশন-এর সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রুমা মোদক ।
Leave a Reply