কবিগুরু ও নবীগঞ্জের দাশগুপ্ত জমিদার পরিবার
রত্নদীপ দাস (রাজু)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আমি শৈশবেই প্রথম পাঠ গ্রহন করি আমার বাবার কাছে [রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯৫৪-২০১৭) বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও নবীগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব; যিনি ব্যক্তিগতভাবে কবিগুরুকে লালন করতেন]। সেই সময়েই জেনেছি কবিগুরু ১৯১৯ সালে সিলেট এসেছিলেন। তাঁর সিলেট আগমনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তৎকালীন সময়ের সিলেটের শিল্প-সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতির অন্যতম ব্যক্তিত্ব গোবিন্দ নারায়ণ সিংহের (১৮৬১-১৯৩২)। কবিগুরুর সাথে সিলেটবাসীর ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। বৃহত্তর সিলেট এমনকি হবিগঞ্জেও ছিল কবিগুরুর স্বাক্ষাত ছাত্র এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাথে সম্পর্কিত লোকজন। তাঁদের মধ্যে- বিপিন চন্দ্র পাল [গ্রাম : পইল, উপজেলা : হবিগঞ্জ সদর, তিনি ভালো রবীন্দ্র পড়ুয়া এবং ছাত্রাবস্থায় তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে যোগাযোগ রাখতেন], সৈয়দ মুজতবা আলী [কবিগুরুর ছাত্র ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক, হবিগঞ্জ], শিক্ষাবিদ সতীশ চন্দ্র রায় [(১৮৮৮-১৯৬০) হবিগঞ্জ, বিদগ্ধ রবীন্দ্র প্রেমি ও কবিগুরুর স্নেহধন্য], রমাকান্ত রায় [(১৮৭৩-১৯০৬) গ্রাম : জলসূখা, উপজেলা : আজমিরীগঞ্জ, তিনি কলকাতা সিটি কলেজে পড়াকালীন সময়ে ঠাকুর বাড়িতে যাতায়াত করতেন। খনি বিজ্ঞান নিয়ে জাপানে পড়তে যাওয়ার সময় কবিগুরু তাঁকে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁর ছোট ভাই শ্রীকান্ত রায় ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী। তিনি ঠাকুর বাড়িতে বাঁধাহীন প্রবেশ করতেন। ], শিবধন ভট্টাচার্য বা শিবধন বিদ্যার্ণব [(১৮৭১/১৮৭২ – ১৯৩৯/১৯৪০) গ্রাম : আদাঐর, উপজেলা : মাধবপুর ; তিনি কবিগুরুর মাধ্যমে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপণ্ডিত নিযুক্ত হয়েছিলেন। কবিগুরু শান্তিনিকেতনে ব্রম্মচর্যাশ্রম করলে তিনি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। কবিগুরুর পরিবারের সাথে তাঁর ৩৫ টি বছর কাটে।], কামিনী কুমার চন্দ [ হবিগঞ্জ জেলার ছাতিয়াইন গ্রামের বিখ্যাত এই আইনজীবী ছিলেন কংগ্রেস নেতা। তাঁর বড় ছেলে অপূর্বকুমার চন্দ (১৮৯৩-১৯৬৮) রবীন্দ্রধন্য শিক্ষাবিদ। ছোট ছেলে অনিলকুমার চন্দ (১৯০৬-১৯৭৬) রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব ছিলেন।]। নবীগঞ্জ থানার গুজাখাইড় গ্রামের দাশগুপ্ত জমিদার পরিবারের চার ভাই বোন- (১) হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (শুধু), (২) গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (মধু), (৩) গৌরীপ্রভা দাশগুপ্ত (লক্ষ্মী), (৪) কালিপ্রভা দাশগুপ্ত (কালি) কবিগুরুর সান্নিধ্যে থেকে সরাসরি পাঠগ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন। বাল্যকালে কবিগুরু ও তাঁদের সম্পর্কে আলোচনা শিহরণ জাগাত মন। তবে সেসময় উনাদের সম্পর্কে বিস্তর জানা হয়নি। শুধু জানতাম তাঁরা ছিলেন নবীগঞ্জের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বিধুবাবু’র [শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (১৯২৭-২০১৩) বৃৃৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সৈনিক ও মক্তিযুদ্ধের কিংংবদন্তি পুরুষ] বড় ভাই-বোন। বুনেদী এই পরিবারের সাথে কবিগুরুর বেশ কিছু ছবি, টেলিগ্রাম, চিঠিপত্র, সনদ, প্রশংসাপত্র সহ অনেক স্মরণীয় স্মৃতির স্মারক থাকলেও অধিকাংশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর লুুুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সামান্য কিছু তথ্য ও ছবি যেটুকু পেয়েছি, সেটুকু দিয়েই বিখ্যাত এই পরিবারের কবিগুরুর শিষ্যদের নিয়ে আলোচনা কারার সীমিত প্রয়াস আমার এ নিবন্ধ।
এককালের বৃহত্তর সিলেট জেলার নবীগঞ্জ থানার বর্ধিষ্ণু ‘দাশগুপ্ত’ জমিদার পরিবার, যা আজও নবীগঞ্জের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে সমাদৃত। যদিও কালের অমোঘ টানে বিখ্যাত এই পরিবারের কেউই আর এখন নবীগঞ্জে নেই। এককালের জমজমাট পরিবারটিও এখন অণু পরিবারে পরিনত হয়ে গেছে। কবিগুরুর শিষ্য জমিদার গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত মধুবাবুুুর জ্যেষ্ঠ্য সন্তান ভারতী দাশগুপ্ত কলকাতায় ও একমাত্র পুুুত্র প্রকৌশলী সোমনাথ দাশগুপ্ত পার্থ সুদূর মার্কিন প্রবাসী।
এই পরিবারের পূর্ব পুরুষ রামনাথ দাশগুপ্ত। তিনি আনুমানিক ৩০০ বছর পূর্বে ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমার বিক্রমপুর পরগনার মহেশ্বরদী থেকে নবিগঞ্জের গুজাখাইর গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন ও জমিদারির পত্তন করেন। তাঁর তিন পুত্র যথাক্রমে ১.গোপীনাথ দাশগুপ্ত, ২. জগন্নাথ দাশগুপ্ত, ৩. কাশীনাথ দাশগুপ্ত। জ্যেষ্ঠ্য পুত্র গোপীনাথ দাশগুপ্ত ফার্সিতে পড়াশোনা করে রাজকর্যে নিয়োজিত হন এবং পরে নবিগঞ্জ মুন্সেফি কোর্টে ওকালতি করেন ও জমিদারি পরিচালনা করেন। ২য় পুুুত্র জগন্নাথ দাশগুপ্ত অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন, কনিষ্ঠ পুত্র কাশীনাথ দাশগুপ্তের প্রৌপুত্ররা ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। জমিদার গোপীনাথ দাশগুপ্তের একমাত্র পুত্র হরনাথ দাশগুপ্ত। জমিদার হরনাথ দাশগুপ্তের ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে ছিলেন। জ্যৈষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৮০-১৯৫২) এফ.এ পাশ করেন এবং কনিষ্ঠপুত্র মহেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত পড়াশোনা শেষ করে শিলচর নরমাল স্কুলে (শিক্ষক প্রশিক্ষন স্কুুল) কর্মরত কালে অবিবাহিত অবস্থায় পরলোক গমন করেন। ৩ মেয়ের বিবাহ ও বড় ছেলে সুরেন্দ্রনাথের বিবাহের পর জমিদার হরনাথ দাশগুপ্ত মৃত্যু বরন করেন।
পিতার মৃত্যুর পর সুরেন্দ্রনাথ অনুভব করলেন শিক্ষার জন্য বাইরে থাকায় জমিদারির অনেকটা হাতছাড়া বা ভান্ডারে তেমন আর্থিক সঙ্গতি নেই যে, তা দিয়ে উদ্ধার করবেন। তাই তিনি ঠিক করলেন আগে উপার্জন ও পরে এসে জমিদারি উদ্ধার। সুরেন্দ্রনাথ খুব আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ইচ্ছে করলে শ্বশুড়বাড়ি থেকে অর্থ সাহায্য নিতে পারতেন। কারন তাঁর স্ত্রী গুরুকুমারী দাশগুপ্ত ছিলেন অবিভক্ত আসামের প্রথম সারির চা ব্যবসায়ী ও তদানীন্তন সিলেট ইলেকক্টিক সাপ্লাই কোম্পানী মালিক স্বর্গীয় বি.সি. গুপ্তের নাতনী। আজও শিলচার গেলে যে কাউকে জিজ্জেস করলে একডাকে ‘বি.সি.গুপ্তের কম্পাউন্ড’ অর্থাৎ বি.সি. গুপ্তের বাড়ী দেখিয়ে দেবে। এরই মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত নিজ জমিদারি তাঁর মা ও কর্মকর্তাদের পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলে সেনাবাহিনীর প্রশাসনের উচ্চ পদে প্রায় ১৬/১৭ বছর চাকুরী করেন। তাঁর কর্মময় জীবন অবিভক্ত আসামের মনিপুর রাজ্যের ইম্ফালে অতিবাহিত করেন এবং একটা সময় পৈত্রিক জমিদারি মজবুত করেন। তাঁর ৫ পুত্র ও ৫ কন্যা, তাঁরা যথাক্রমে- (১) শান্তিপ্রভা দাশগুপ্ত (১৯১১ – ২৩.০৪.১৯৮৪), (২) হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (শুধু; ১৯১৩ – ১৯৩৬), (৩) গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (মধু; ০৮.০৪.১৯১৫ – ১৮.১০.২০১৬), (৪) গৌরীপ্রভা দাশগুপ্ত (লক্ষ্মী; ১৯১৯ – ০৬.০৪.২০০৬) (৫) কালিপ্রভা দাশগুপ্ত (কালি; ১৯২২ – ২১.১১.২০০৬), (৬) শক্তিপ্রভা দাশগুপ্ত (১৯২৫ – ১৯৯৩), (৭) শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধু; ২৭.০৫.১৯২৭ – ০৯.০৩.২০১৩), (৮) শিবপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (শিবু; ১৯৩০- ১৯৩৭), (৯) ভক্তিপ্রভা দাশগুপ্ত (১৯৩৩ – ২০০৮), (১০) শম্ভুনাথ দাশগুপ্ত (১৯৩৫ – ৩১.১০.২০০৬)। জমিদার সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৮০-১৯৫২) ছিলেন একজন প্রজা বৎসল, সজ্জন ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর সময়ে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করেন।
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর সন্তানদের মণিপুরের স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করেন। প্রতিদিন সকালে ছেলেরা স্কুলে যায় এবং ছুটির পর যথাসময়ে বাড়ি ফিরে। এভাবেই কিছু দিন চলছিল তাদের দুরন্তপনা। কিন্তু একদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে জানান যে, তাঁর ছেলেদের স্কুলে উপস্থিতির হার খুব কম। তিনি তখন আকাশ থেকে পড়লেন! ভাবতে লাগলেন ওরা বাসা থেকে বের হয়ে যায় কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে এল, তাঁরা স্কুলে ঠিকই রওনা দেন, কিন্তু পথিমধ্যে জামাকাপড় খুলে নদীতে সাঁতার কেটে ও নানা ধরনের দুষ্টুমি করে স্কুল ছুটির সময় সুবোধ বালকের মতো ফিরে আসেন। এ ঘটনায় মোড় নিল এক নতুন অধ্যায়ের। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর আশ্রমে দিয়ে আসবেন।
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বড় মেয়ে শান্তিপ্রভা তখন বিয়ের বয়স অর্থাৎ ১৬-১৭ বছর বয়স। তাই তাঁর যাওয়া হলো না। ছোট তিন ছেলে-মেয়ে শিবপ্রসন্ন দাশগুপ্ত শিবু, ভক্তিপ্রভা দাশগুপ্ত ও শম্ভুনাথ দাশগুপ্ত শম্ভু অনেক ছোট, তাই তাঁদেরও যাওয়া হলো না। তিনি তিন পুত্র হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বীর মুক্তিযোদ্ধা বিধু বাবু নামে যিনি সুপরিচিত) এবং তিন কন্যা গৌরীপ্রভা দাশগুপ্ত লক্ষ্মী, কালীপ্রভা দাশগুপ্ত ও শক্তিপ্রভা দাশগুপ্তকে নিয়ে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে আনুমানিক ১৯২৭ সালে কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে ভর্তি করার উদ্দেশ্যে ইম্ফল থেকে সুদূর শান্তিনিকেতনে যাত্রা করেন। তখনকার সময়ে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ী করে যেতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগতো ইম্ফল থেকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছুতে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে পুত্র-কন্যাদের ভর্তি করে, সে সময় প্রায় ৪ মাস ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে বাড়ী ভাড়া করে থাকেন। তাঁরা মানসিকভাবে সেখানে বসবাসের উপযোগী কি না তা যাচাই করার জন্য। সুরেন্দ্রনাথ কবিগুরুর জন্য উপহার হিসেবে একটি জালি বেতের গল্লা উপহার দিয়ে ছিলেন, কবিগুরুও অনেক খুশি হয়ে ছিলেন সূদুর মণিপুর থেকে আসা একজন সেনাকর্মকর্তার নিকট থেকে অতিমনোরম একটি গল্লা উপহার হিসেবে পেয়ে। আরো অনেক আনন্দিত হন জমিদার পরিবারের আদরের ছয় ছেলে-মেয়েকে তাঁর কাছে সঁপে দেওয়ায়। সেই সময় পুরো পরিবারটির কবিগুরু ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং বিশ্বভারতীর তদানীন্তন শিক্ষক যেমন – নন্দলাল বসু, তনয় ঘোষ প্রমুখদের সঙ্গে এক আত্মিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। সেখানে ভর্তি হন – (১) হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বড় পুত্র, বয়স ১৪, ৮ম শ্রেনী, যার ডাক নাম শুধু), (২) গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (দ্বিতীয় পুত্র,বয়স ১২, ৬ষ্ঠ শ্রেনী, ডাক নাম মধু), (৩) গৌরীপ্রভা দাশগুপ্ত (দ্বিতীয় কন্যা, বয়স ৮, প্রথম শ্রেণী, ডাক নাম – লক্ষ্মী), (৪) কালিপ্রভা দাশগুপ্ত (তৃতীয় কন্যা, বয়স ৭, শিশু বিভাগ, ডাক নাম কালি)। বয়স নিতান্ত কম হওয়ায় দুই কন্যাই পাঠ ভবনে ভর্তি হন এবং ছেলেরা ছেলেদের হোস্টেলে। অন্য দুজন শক্তিপ্রভা ও শ্যামাপ্রসন্ন (বিধুবাবু) বয়স কম হওয়ায় কান্নাকাটি করে চলে আসেন। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ৪ মাস পর ফিরে যান কর্মস্থল ইম্ফলে। এর পরের বছর ছুটিতে বাড়ি ফিরে জ্যেষ্ঠ কন্যা শান্তিপ্রভার বিয়ের আয়োজন করেন। পাত্র নবিগঞ্জের জন্তরী গ্রামের বর্ধিষ্ণু দত্ত বংশের। পরে উনিও ইম্ফালে আসাম সরকারের প্রশাসনিক বিভাগে চাকুরী করতেন।
হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত [(শুধু), ১৯১৩-১৯৩৬] পিতার কর্মস্থল অর্থাৎ মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানেই সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি শান্তিনিকেতনে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং শান্তিনিকেতনে ইংরেজীতে অনার্স পড়াকালীন কোলকাতায় চলে আসেন ও আইন পড়া শুরু করেন এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, হরপ্রসন্ন ২ বৎসর পরিশ্রম করে মিলিটারি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েও যোগদান করার কিছু দিন আগে কঠিন টাইফয়েড রোগে ভোগে কোলকাতায় মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে (তখন টাইফয়েড রোগের ভাল চিকিৎসা ছিল না) পরলোক গমন করেন । কবিগুরুর একান্ত স্নেহের পাত্র হরপ্রসন্নকে কবি নিজ হাতে স্বাক্ষর করা প্রসংশা পত্র দিয়েছিলেন। সেই প্রসংশা পত্রের ভাষা পড়লেই বুঝা যায় কবি হরপ্রসন্নকে কত খানি ভালবাসতেন। হরপ্রসন্নের সহপাঠি ছিলেন- নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের মা (নন্দলাল বসুর কন্যা) অমিতা বসু (পরে অমিতা সেন), সাগরময় ঘোষ (সম্পাদক, দেশপত্রিকা) প্রমুখ।

গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত [(মধু), মার্চ ১৯১৫ – ১৮.১০. ২০১৬] পিতার কর্মস্থল ইম্ফলে প্রথমিক স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি শান্তিনিকেতনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মাস্টার্স পাশ করেন। গুরুপ্রসন্নের সহপাঠি ছিলেন ত্রিপুরার রাজবাড়ীর ছেলে রমেন্দ্র নারায়ন মানিক্য, রবীন্দ্র সংগীত গায়ক সন্তেষ কুমার ঘোষ প্রমুখ।
গৌরীপ্রভা দাশগুপ্ত [(লক্ষী), ১৯১৯ – ০৬.০৪.২০০৬] আট বছর বয়সে বিশ্বভারতীতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে তিনি এন্ট্রাস পাশ করেন।
কালীপ্রভা দাশগুপ্ত [কালী, ১৯২২ – ২৩.০৪.১৯৮৪] শান্তিনিকেতনেই শিশু বিভাগে ভর্তি হয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। কালিপ্রভা খুব ভাল নাচতেন বলে কবিগুরুর নাচের গ্রুপের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন। কবিগুরুর নাচের ট্রুপের সঙ্গে ওয়ালটেয়ার, কোলকাতা ও অন্যান্য জায়গায় নৃত্য পরিবেশন করেছেন। কবিগুরু কালীপ্রভাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এর প্রমান পাওয়া যায় তাঁর কবিগুরু স্বহস্তে লেখা একটি কবিতার মাধ্যমে –
“উঁচু গাছে চড়ে বসে,
মনিপুরী নাচ নাচে।
রং তার কালো নয়,
নাম তার কালী।
কালী, তোর নাম কে রাখিল কালী।”
এই কবিতাটি কবিগুরু কালীপ্রভার খাতার মলাটে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে লিখে দিয়েছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী (ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) নবম শ্রণিতে কালীপ্রভার সহপাঠিনী ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কালীপ্রভা কবিগুরুর সাথে শান্তিনিকেতনে তুলা ছবিটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি ছবিটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। আজীবন তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ছবিটা দিল্লিতে “ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল” এ এখনো স্বযত্নে সংরক্ষিত আছে।
হরপ্রসন্ন মারা যাওয়ার সময় অর্থাৎ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ইতিহাসে এম.এ প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গৌরীপ্রভা সবে ম্যাট্রিক পাশ করে শান্তি নিকেতনেই ভর্তি হয়েছেন। আর কালিপ্রভা ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। এই মর্মান্তিক ঘটনার পরপরই দাশগুপ্ত পরিবারে নেমে আসে আরেকটি মর্মন্তুদ ঘটনা। এর এক বছরের মাথায় ৪র্থ পুত্র শিবপ্রসন্ন (বয়স ১১, ডাক নাম শিবু) ধণুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরন করেন। পরপর দুই পুত্রের মৃত্যুতে সুরেন্দ্রনাথ দম্পতি মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হন এবং ভগ্ন হৃদয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থ স্থান ভ্রমন করতে শুরু করেন। প্রায় ৬ মাস তীর্থ ভ্রমন করে কোন এক তীর্থ স্থান থেকে গোপীনাথের মূর্তী এনে গুজাখাইড়ের বাড়িতে স্থাপন করেন “গুপীনাথ মন্দির”। এদিকে গুরুপ্রসন্ন মাস্টার্স পাশ করলে সুরেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে থাকা দুই কন্যাকে নিজের কাছ ছাড়া না রাখতে বাড়ি নিয়ে আসেন এবং সিলেট শহরে এই দুই কন্যা সহ অন্যান্য পুত্র কন্যাদের সিলেট পাইলট স্কুল ও এমসি কলেজে ভর্তি করেন। যদি এই বিপর্যয় নেমে না আসতো, তাহলে তাঁর অন্য পুত্র কন্যারাও কবিগুরুর সান্নিধ্যে শান্তি নিকেতনেই পড়াশোনা করতেন। পারিবারিক বিপর্যয়ের ফলে সুরেন্দ্রনাথ আর চাকুরীতে ফিরে যান নাই। ইম্ফালের পাট গুটিয়ে সিলেট শহরে বাসা নিয়ে সেখানেই বহু বছর বসবাস করেন ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার সুবিধার্থে। সিলেট আসার ২ বৎসর পর গৌরীপ্রভা ও কালিপ্রভার বিয়ের আয়োজন করেন।
গৌরীপ্রভার বিয়ে হয় মৌলভীবাজারের ইন্দেশ্বর গ্রামের শ্যাম পরিবারে। পাত্র গোল্ড মেডেলিস্ট ইঞ্জিনিয়ার মনীন্দ্র চন্দ্র শ্যাম (বর্তমান বাংলাদেশের বিশিষ্ট সুরকার সুজেয় শ্যাম আপন ভতিজা ও গায়ক শুভ্র দেব ভিতিজির দিকে নাতী)। মনিন্দ্র চন্দ্র শ্যাম বহু নামী কোম্পানীতে চাকুরী করেন, যেমন – কাশীপুর গান ফ্যাক্টরী ইত্যাদি। পরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে সেকেন্ড ম্যান হিসাবে বেশ কয়েক বছর চাকুরী করার পর সেখান থেকেই অবসর নিয়ে কোলকাতাবাসী হন। কারন সিমেন্ট কোঃ কাজ করলেও তিনি ইন্ডিয়ার ‘অপশন’ দিয়ে ছিলেন।
কালীপ্রভার বিয়ে হয় কলকাতার তখনকার বিশিস্ট ব্যবসায়ী ব্রাহ্ম পরিবারে। পাত্রের নাম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। দত্ত পরিবারটি খুবই আধুনিক মন সম্পন্ন ও সাহিত্য চর্চায় সুপন্ডিত ছিলো। তখনকার সময়ে তাঁদের বাড়িতে বড়ো বড়ো সাহিত্যিকরা প্রায় সন্ধ্যায় আড্ডা বসাতেন। সিনেমা শিল্পের লোকজন, যেমন- কাননবালা, হরিদাস ভট্টাচার্য, মলিনা দেবী, হরিসাধন দাশগুপ্ত, দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ এরা নিত্যদিনের সন্ধ্যার আড্ডার সঙ্গী ছিলেন। সুধীন্দ্র নাথ দত্ত সুলেখক হিসাবেও পরিচিতি ছিল। তাঁর রচনার মধ্যে ‘লক্ষ্মীর কৃপালাভ – বাঙ্গালীর সাধনা’ বইটি কিছুটা রিসার্চধর্মী হলেও ৭০ দশকে সাহিত্যাঙ্গনে বেশ আলোড়ন ফেলেছিল।
কবিগুরু গৌরীপ্রভা ও কালিপ্রভার বিয়ের সময় আশীর্বাদ স্বরূপ রূপার পানের বাটা ও টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটি বাঁধানো অবস্থায় গুজাখাইরের বাড়ীতে ছিল। হরপ্রসন্নদের চার ভাইবোনের শান্তিনিকেতনের যত অমূল্য স্মৃতি জড়িত চিঠি পত্র, টেলিগ্রাম, প্রসংশা পত্র, ছবি বেশীরভাগই ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কর্তৃক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (মধুবাবু) শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন সময়ে যেমন মেধার স্বাক্ষর রাখেন, তেমনি টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবেও ছিলেন বিখ্যাত। দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনে পড়ার সুবাদে তিনি কবিগুরুর বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত হন এবং হরপ্রসন্ন ও গুরুপ্রসন্ন ভাতৃদ্বয় কবিগুরুর প্রিয় শিষ্যে পরিণত হন। এই ভাতৃদ্বয়ের নিজস্ব ক্যামেরায় তৎকালীন সময়ে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তোলা বিরল ছবি ফ্রেমে বন্দী হয়।
Leave a Reply